সত্য ও কঠোর বাস্তবকে একত্রে মিশাইয়া তাল পাকাইয়া ফেলা একটা মারাত্মক ভুল। আমাদের জীবন কেবল বাস্তব ঘটনা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় না; জীবন গঠনে আশারও যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। সত্য বলিতে গিয়া যদি বাস্তব ঘটনা ছাড়া আর কিছু না বুঝায় তবে এরূপ সত্যনিষ্ঠা মানব মনের পক্ষে কারাগারস্বরূপ হইয়া দাঁড়ায়। কল্পনা যদি মনের বাসনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার পরিবর্তে কেবল অলস স্বপ্নেই পর্যবসিত থাকে কেবল তখনই তাহা নিরুৎসাহ করা উচিত; কিন্তু কল্পনা যখন কাজের প্রেরণা জোগায় তখন ইহা মানুষের আদর্শগুলিতে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করিতেই সাহায্য করে। শৈশবে কল্পনাকে পিষিয়া মারিয়া ফেলিলে মানুষ বস্তুতান্ত্রিকতার দাসরূপে পরিণত হয়; মাটির পৃথিবীর বাস্তব দীনতা, হীনতা, তুচ্ছতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ থাকিয়া সে ভাবের স্বর্গলোক সৃষ্টি করিতে পারে না। আপনি হয়তো বলিবেন এ সবই উত্তম কিন্তু শিশু ভক্ষণকারী দৈত্যের সঙ্গে অথবা স্ত্রী হত্যাকারী ব্লু-বিয়ার্ডের সঙ্গে ইহার কি সম্বন্ধ? আপনার স্বর্গে কি এ সব থাকিবে? কল্পনা যাহাতে সত্যই কোনো ভালো কাজে লাগে সে জন্য কি ইহা বিশুদ্ধ ও উন্নত ধরনের করিতে হইবে না? আপনি তো একজন শান্তিবাদী কিন্তু আপনার নির্দোষ শিশু মানুষ হত্যার চিন্তায় আনন্দ পাইবে। ইহা কি আপনি সমর্থন করিবেন? মানুষ আদিম প্রবৃত্তিগত বর্বরতার স্তর পার হইয়া আসুক ইহাই কাম্য, কিন্তু নিষ্ঠুরতার চিন্তায় শিশু যে আনন্দলাভ করে তাহা আপনি কিভাবে সমর্থন করিবেন? পাঠক হয়তো এইরূপ চিন্তা করিতেছেন। এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ; কেন আমি এ বিষয়ে পৃথক অভিমত পোষণ করি তাহাই বিবৃত করিতে চেষ্টা করিব।
প্রবৃত্তিগুলি দমন করিয়া রাখিলেই শিক্ষাদান সম্পূর্ণ হইল না; এগুলির যথাযথ বৃদ্ধি এবং মঙ্গলজনক কাজে নিয়োগ করিতেই শিক্ষার সার্থকতা। মানব প্রবৃত্তিগুলি বড়ই অস্পষ্ট; ইহারা কোনো নির্দিষ্ট আকারে কোনো নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হয় না, নানাভাবে ইহাদের তৃপ্তিসাধন করা যায়। বেশিরভাগ প্রবৃত্তিরই পরিতৃপ্তির জন্য কোনও প্রকার কৌশল আবশ্যক। ক্রিকেট এবং বেসবল একই প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করে কিন্তু বালক যে খেলাটি জানে সেইটিই খেলিবে। বালকের ক্রীড়াপ্রবৃত্তির তৃপ্তিসাধনের জন্য শুধু যে একই নির্দিষ্ট প্রকার খেলার কৌশল আয়ত্ত করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কাজেই চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তাহার মূল সূত্র হইল মানুষকে এমন কৌশল আয়ত্ত করানো যাহাতে সে তাহার প্রবৃত্তিগুলিকে ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগাইতে পারে। শক্তিমান হওয়ার যে বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য শিল্প কল্পনায় অত্যাচারী, নিষ্ঠুর,–বিয়ার্ড সাজিয়া নিজের ক্ষমতার পরিচয় দেয়, পরবর্তীকালে সেই বাসনাই পরিতৃপ্তির জন্য অন্য পথ খোঁজে, শৈশবের সেই ক্ষমতাকামী কল্পনাপ্রবণ কামনা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, শিল্পসৃষ্টি, শিক্ষার ভিতর দিয়া উন্নত প্রকৃতির মানুষ সৃষ্টি প্রভৃতি অসংখ্য রকমের উৎকৃষ্ট কাজের মধ্যে সার্থকতা লাভ করে। কোনো লোক যদি কেমন করিয়া যুদ্ধ করিতে হয় কেবল তাহাই জানে তবে যুদ্ধই হইবে তাহার আনন্দের বিষয়। কিন্তু যদি অন্যান্য বিষয়েও তাহার নিপুণতা থাকে তবে আরও অনেক উপায়ে তাহার বাসনা চরিতার্থতা লাভ করিতে পারে। যদি তাহার শক্তিলাভের বাসনা শৈশবেই বিনাশ করিয়া ফেলা হয় তবে সে হইবে উদ্দেশ্যবিহীন এবং অলস। ভালো বা মন্দ কোনোপ্রকার কাজ করার ক্ষমতাই তাহার থাকিবে না। এই রকম নিরীহ, নিবীর্য নিষ্ক্রিয় ভালো মানুষ দ্বারা জগতের কোনো উপকারই হয় না; আমাদের শিশুদিগকে আমরা এইভাবে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে পরিণত করিতে চাই না। বাল্যকালে শিশুরা বর্বরতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কল্পনায় তাহারা অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার অভিনয় করিতে ভালোবাসে, দৈহিক বিক্রমের প্রকাশ তাহাদের নিকট আনন্দদায়ক। শিশুর ক্রমবিকাশের পক্ষে এরূপ আচরণ তাহার জৈবিক প্রয়োজন বলিয়া গণ্য করা হয়। ক্রম বিবর্তনের ফলে আদিম হিংস্র বর্বর মানব বর্তমানে সভ্য মানবে রূপান্তরিত হইয়াছে। বয়স্ক সভ্য মানুষ তাহার আদিম পূর্বপুরুষের আচরণ অনুসরণ করে না, করিলে সভ্য সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত না, পৃথিবী নবরূপী হিংস্র পশুর আবাসে পরিণত হইত। মানব-শিশু তাহার জীবনের প্রথম কয়েক বৎসর কল্পনা ও আচরণের ভিতর দিয়া আদিম মানুষের জীবনস্তর পার হইয়া আসে। এই সময় তাহারা থাকে ছোট, তাহাদের ক্ষতি করার সামর্থ্যও থাকে কম; কাজেই বর্বর আদি মানবের অভিনয় করিলেও তাহারা সমাজের কোনো অপকার করিতে পারে না। তাহাদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য উন্নততর কোনো কৌশল আয়ত্ত করিতে পারিলে তাহারা বর্বরের স্তরে থাকিয়া যাইবে না। অতএব বাল্যে যেরূপ কল্পনায় তাহারা আনন্দ অনুভব করে পরবর্তীকালেও যে তাহারা সেই কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চাহিবে এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নাই। বাল্যকালে ডিগবাজি খাইতে আমি খুব আনন্দবোধ করিতাম। এ কাজ যদিও খারাপ মনে হয় না তবু আমি আর এখন ডিগবাজি খাই না। সেইরূপ যে শিশু এখন ব্লু-বিয়ার্ড সাজিতে ভালোবাসে পরে রুচির পরিবর্তন ঘটিলে সে অন্য উপায়ে তাহার কামনা তৃপ্ত করিবে। বাল্যকালে শিশুর দেহ মনের উপযোগী উদ্দীপকের [Stimuli] সাহায্যে যদি তাহার কল্পনা সরস ও সজীব রাখা হয়, তবে সেই শিশু যখন বয়স্ক মানুষে পরিণত হইবে তখন তাহার কল্পনা বয়স্ক ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নানা প্রবৃত্তিকে বাস্তবরূপ দিতে সাহায্য করিবে। শৈশবে শিশুর মনে নৈতিক ভাব বা আদর্শ প্রবেশ করাইবার চেষ্টা করা বৃথা; ইহাতে তাহাদের কোনো সাড়া পাওয়া যাইবে না; ওই বয়সে তাহাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এইরূপ নৈতিক উপদেশের কোনো প্রয়োজন নাই। এইরূপ করিলে শিশুর মনে আসিবে অবসাদ এবং ফল হইবে যে, যে-বয়সে শিশু এই ভাব গ্রহণে সক্ষম হইত তখনও সে উহা গ্রহণ করিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাইবে না। অপ্রবেশ্য শিলায় জল জমিলে তাহা যেমন চুয়াইয়া নিচে নামে না শিশুর মনেও তেমনই নৈতিক ভাব গ্রহণের বিরুদ্ধে একটি শক্ত স্তর গঠিত হইবে। ভিন্ন ভিন্ন বয়সে শিশুর মনে গতি-প্রকৃতি কেমন থাকে তাহা প্রত্যেক পিতামাতা এবং শিক্ষকের জানা দরকার। এজন্যই শিশু মনস্তত্ত্ব শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলিয়া গণ্য করা হয়।