যাহা হউক শক্তিমান হওয়ার বাসনাই যে শিশুর খেলার প্রেরণা জোগাইবার একমাত্র উৎস তাহা অনুমান করিলে বিষয়টি অযথাভাবে সহজ করিয়া দেখা হইবে। ইহার মূলে আরও অন্য কারণ আছে। শিশুরা ভয় পাওয়ার ভান করিতে আমোদ পায়; ইহার কারণ বোধহয় এই যে ইহা যে ভান সত্য নয় এই জ্ঞান তাহাদের নিরাপত্তার বোধ বৃদ্ধি করে। সময় সময় আমি কুমিরের ভান করিয়া ছেলেকে খাইতে আসি। সে এমন স্বাভাবিকভাবে চিৎকার করিয়া উঠে যে, সে সত্যই ভয় পাইয়াছে, মনে করিয়া আমি থামিয়া যাই, কিন্তু আমি থামা মাত্রই সে বলিয়া উঠে, বাবা আবার কুমির হও। নাটক অভিনয়েও এই ভান আনন্দ দেয়; ইহার জন্যই বয়স্ক ব্যক্তিরা উপন্যাস ও নাটক অভিনয় পছন্দ করেন। আমার মনে হয় এ সকলের মধ্যে কৌতূহলের বিশেষ স্থান আছে। ভালুক সাজিয়া শিশু ভালুক সম্বন্ধে কিছু কিছু শিখিল মনে করে, যেমন ভালুক কেমন করিয়া হাঁটে, কেমন শব্দ করে, কেমন পোষ মনে ও নাচে ইত্যাদি। আমি মনে করি যে শিশুর জীবনের প্রত্যেকটি প্রবল আবেগ তাহার খেলার ভিতর প্রতিফলিত হয়। ক্ষমতা বা শক্তি শিশুর বাসনার মধ্যে যেরূপ প্রাধান্য লাভ করে তাহার খেলার ভিতরেও সেই পরিমাণে তাহার প্রাধান্য প্রকাশ পায়। ক্ষমতার প্রতি যদি তাহার ঝোঁক বেশি থাকে তবে খেলায় সে এরূপ ভানই ভালোবাসিবে যাহাতে সে নিজেকে শক্তিশালী বলিয়া মনে করিতে পারে। এইভাবেই তাহার বাসনা কতকটা তৃপ্তি লাভ করে।
খেলার শিক্ষামূল্য কি, শিশুর শিক্ষাদান ব্যাপারে খেলা কতখানি সাহায্য করে সে বিষয় আলেচনা করিলে সকলেই স্বীকার করিবেন যে, যে-খেলার ভিতর দিয়া শিশু নূতন প্রবণতা ও কৌশল আয়ত্ত করে তাহা উপকারী ও প্রশংসনীয়। কিন্তু আধুনিককালের অনেকে ভান বা কল্পনা অবলম্বনে শিশু যে খেলা করে তাহার শিক্ষামূল্য সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। বয়স্ক যুবক যখন মনের রুদ্ধ কামনাগুলির তৃপ্তির জন্য জাগর স্বপ্নে অর্থাৎ রঙিন কল্পনাবিলাসে মগ্ন হয়, তখন ইহাকে একপ্রকার মানসিক রোগ বলিয়া অভিহিত করা যায়। মনের বাসনাকে কার্যে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে জাগর স্বপ্নবিলাসী নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকিয়া কল্পনায় বাসনার সার্থকতা আস্বাদ করিতে চায়। এই প্রকার অলস কল্পনাবিলাস কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। ইহার উপর সাধারণ মানুষের যে বিরূপ ভাব আছে তাহা কালক্রমে শিশুর কল্পনাবিলাসের উপরও গিয়া পড়িয়াছে। শিশুরা যেন তাহাদের খেলার সরঞ্জামগুলি রেলগাড়ি বা স্টিমার বা অন্য কোনো কিছু বলিয়া কল্পনা করিয়া লইবে, মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তাহা পছন্দ করেন না। তাঁহারা ইহাকে বলেন বিশৃঙ্খল কল্পনা। তাহাদের অভিমত সম্পূর্ণ সত্য, কেননা শিশুরা এভাবে প্রকৃতই কোনো খেলায় মগ্ন হইতেছে না। এমনকি শিশুদের নিজেদের নিকটও ইহা পূর্ণাঙ্গ খেলা বলিয়া মনে হয় না। মন্তেসরি সরঞ্জাম শিশুকে আনন্দ দেয়; এ সরঞ্জামের উদ্দেশ্য শিশুকে শিক্ষা দেওয়া; এখানে আনন্দ শিক্ষাদানের একটি উপায় মাত্র। কিন্তু প্রকৃত খেলায় আনন্দ লাভই প্রধান উদ্দেশ্য। কাজেই মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিক্ষা সরঞ্জাম লইয়া খেলা ও প্রকৃত খেলা সম্পূর্ণ একপ্রকার নয়। বিশৃঙখল কল্পনা সম্বন্ধে যে আপত্তির সঙ্গত কারণ আছে তাহাই যদি আসল খেলার বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয় তবে ইহা একটু বাড়াবাড়ি হইবে। শিশুকে পরি, দৈৰ্ত, ডাইনি জাদুভরা কার্পেট প্রভৃতি অবাস্তব গল্প শুনাইতে যাহারা আপত্তি করেন তাহাদের সম্বন্ধে এ কথা বলা যায় যে শিশুকে সত্য ও বাস্তবের উপর গড়িয়া তুলিতে গিয়া তাঁহারা বাড়াবাড়ি করিতেছেন। এই ধরনের সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির সহিত আমি একমত হইতে পারি না। এরূপ বলা হয় যে শিশুরা বাস্তব এবং বাস্তবের ভানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করিতে পারে না কিন্তু ইহা বিশ্বাস করার কোনো কারণ আমি দেখি না। বাস্তব জগতে কখনও হ্যামলেট ছিল বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন আমরা হ্যামলেট নাটকের অভিনয় দেখিতেছি তখন যদি কেহ সর্বদা বলিতে থাকে এ কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক তখন আমরা বিরক্ত না হইয়া পারি না। সেইরূপ শিশু যখন কোনো কিছুর ভান করিয়া খেলার আনন্দ উপভোগ করিতে থাকে তখন ইহাকে কখনোই সত্য বলিয়া গ্রহণ করে না কিন্তু কেহ যদি তাহাকে সর্বদা স্মরণ করাইয়া দেয় যে ইহা নিছক মিথ্যা তবে সে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করে।
সত্য এবং কল্পনা উভয়ই প্রয়োজনীয় কিন্তু জাতির ইতিহাসে যেমন, ব্যক্তির জীবনেও তেমনই, কল্পনার স্ফুরণই হয় প্রথমে। যতদিন শিশুর স্বাস্থ্য সবল এবং স্বাভাবিক থাকে ততদিন সে বাস্তব সত্য অপেক্ষা খেলাতেই বেশি আনন্দ পায়। খেলার সময় সে যেন রাজা। বাস্তবিক সে নিজের কল্পনারাজ্যে জাগতিক রাজার অপেক্ষা বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ করিয়া রাজত্ব করিয়া থাকে। বাস্তবে তাহাকে নির্দিষ্ট সময়ে শুইতে হয়, কত রকম আদেশ, হুকুম পালন করিতে হয়, উপদেশ অনুসারে কাজ করিতে হয়। কঠোর কল্পনাবিহীন বয়স্ক ব্যক্তিরা যখন শিশুর এই কল্পনাবিলাসে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে তখন সে অত্যন্ত রুষ্ট হয়। সে হয়তো একটি দেওয়াল তৈয়ারি করিয়াছে এবং কল্পনা করিয়াছে যে সেটি এত উঁচু যে সবচেয়ে বড় দৈত্যও তাহা ডিঙাইতে পারে না; আপনি যদি তাহা ডিঙাইয়া গিয়া হেলায় তাহার কল্পনা তুচ্ছ করিয়া দেন তবে সে আপনার উপর বিরক্ত হইবেই। বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনায় শিশুর হীনতা বোধ একান্তই স্বাভাবিক; ইহা মানসিক রোগের লক্ষণ নয়। তেমনি কল্পনায় এই হীনতা দূর করিয়া নিজের শক্তির পরিচয় দেওয়ার কামনা শিশুর পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক। ইহা কোনোরূপ মনোবিকারের লক্ষণ নয়। খেলায় যে সময় ব্যয়িত হয় তাহা অন্য কোনো প্রকারে ইহার অপেক্ষা সার্থকতরভাবে নিয়োজিত হইতে পারে না, সব সময়ই যদি শিশুকে গুরুতর কাজকর্মে ব্যাপৃত রাখার ব্যবস্থা হয় তবে অচিরেই তাহার স্নায়ু বিকল হইয়া পড়িবে, সে হইবে অসুখি এবং অপদার্থ। যে বয়স্ক ব্যক্তি জাগর স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে তাহাকে কাজে প্রবৃত্ত হইয়া মনের বদ্ধ ভাবগুলিকে বাস্তবে পরিণত করিতে উপদেশ দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু শিশুর পক্ষে এ উপদেশ নিরর্থক, কেননা ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দিবার দৈহিক ও বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও কৌশল তাহার কাছে আশা করা যায় না। কল্পনা তাহার নিকট বাস্তবের স্থায়ী পরিবর্ত [Substitute] নয়; চিরদিন সে কল্পনা লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে প্রস্তুত নয়, উপযুক্ত সময় হইলে সে বরং তাহার কামনাকে বাস্তবে পরিণত করার আশাই মনে পোষণ করে।