কার্যকরি শিক্ষা বলিতে কেহ যদি এইরূই মনে করেন এবং এই অভিমত প্রচার করেন তবে তাহাকে নিশ্চয়ই ভ্রান্ত বলিতে হইবে। তবে যখন অনাহারে লোক মরিতেছে, তখন রাজনীতিক হিসাবে তাঁহার অভিমত ঠিক হইতে পারে কেননা বর্তমান মূহুর্তে জীবনধারণণাপযোগী জিনিসের প্রয়োজন অন্য যে কোনো জিনিস অপেক্ষা বেশি।
এই বিতর্কের অপর দিক আলোচনা করিতেও অনুরূপ বিস্তৃত দরকার। এই দিকটিকে আলঙ্কারিক বলিলে প্রয়োজনীয় শিক্ষার সমর্থকদিগের অভিমত এই রকম মানিয়া লওয়া হয়। কারণ আলঙ্কারিক বলিতে কমবেশি তুচ্ছ জিনিসকেই বোঝায়। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বলিতে মধ্যযুগীয় ধারণার প্রতি আলঙ্কারিক সংজ্ঞা প্রয়োগ করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ভদ্রলোক বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলিতেন, উপযুক্ত ক্ষেত্রে কথাপ্রসঙ্গে প্রাচীন সাহিত্য হইতে কোন্ কোন্ অংশ উদ্ধৃত করিতেন, ফ্যাশন করিয়া পোশাক পরিতেন, আদবকায়দা ভালোমতো বুঝিতেন এবং প্রশংসা অর্জনের জন্য কখন দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করা উচিত তাহা জানিতে।
অতি সংকীর্ণ অর্থে তাঁহার শিক্ষা আলঙ্কারিক হইয়াছিল কিন্তু আমাদের যুগে কোনো ধনবান ব্যক্তিই তাঁহার মতো ভব্যতায় সন্তুষ্ট হইবেন না। প্রাচীন অর্থে আলঙ্কারিক শিক্ষার আদর্শ হইল অভিজাত [Aristocratic]। ইহা বলিতে এমন এক শ্রেণির লোক বুঝায় যাহাদের অর্থ আছে প্রচুর, কাজ করার প্রয়োজন নাই। ভদ্রলোক এবং চমৎকার ভদ্রমহিলাদের কাহিনী ইতিহাসের মনোজ্ঞ বিষয়বস্তু বটে; তাদের আত্মচরিত এবং পল্লির বাসভবন আমাদিগকে আনন্দ দান করে অথচ আমরা তাহা আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য রাখিয়া যাইতে পারিলাম না। কিন্তু তাহাদের চমৎকারিত্ব চরম ছিল বলিয়া মনে করিবার কোনো কারণ নাই, তথাপি ইহার জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণে খরচ করিতে হইত। হগার্থের Ginlane পুস্তক পাঠে আলঙ্কারিক শিক্ষার জন্য কিরূপ খরচ করিতে হইত যে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যায়। বর্তমান যুগে এই সংকীর্ণ অর্থে কেহই আলঙ্কারিক শিক্ষার সমর্থন করিবেন না।
কিন্তু প্রকৃত সমস্যা তাহা নয়। আসল প্রশ্ন হইলঃ সাক্ষাত্তাবে কার্যকরি হয় এমন জ্ঞানদানই কি আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হইবে, না ছাত্রদিগকে মানসিক সম্পদ দানের চেষ্টা করিতে হইবে? বারো ইঞ্চিতে এক ফুট এবং তিন ফুটে এক গজ ইহা জানা প্রয়োজনীয় কিন্তু এই জ্ঞানের কোনো অন্তঃস্থিত মূল্য [Intrinsic value) নাই। যেখানে মেট্রিক প্রণালী প্রচলিত সেখানে তো তাহা একেবারেই অকেজো। পক্ষান্তরে (কাহারও পক্ষে তাহার খুল্লতাতকে হত্যা করার বিরল ঘটনা ছাড়া) হ্যামলেট নাটকের রস উপলব্ধি করার ক্ষমতা দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের কোনো কাজে লাগিবে না। কিন্তু ইহা মানুষকে এমন মানসিক সম্পদ দান করে যাহা হইতে বঞ্চিত হওয়া তাহার পক্ষে আপসোসের বিষয়। এই মানসিক সম্পদই তাহাকে একজন চমৎকার মানুষে পরিণত করিতে পারে। যিনি মনে করেন কার্যকরি জ্ঞানই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তিনি এই ধরনের মানসিক সম্পদ বা ক্ষমতার পক্ষপাতী।
কার্যকরি শিক্ষার সমর্থক ও তাহাদের বিরুদ্ধপক্ষে বিতর্কের তিনটি মূল সমস্যা জড়িত আছে। প্রথমত, অভিজাত ও গণতন্ত্রবাদীদের মধ্যে বিরোধে অভিজাতগণ মনে করেন যে, অধিকারপ্রাপ্ত [Priviledged] শ্রেণির জন্য শিক্ষা এমন হইবে যেন তাহারা অবসর সময় আরামে বিলাস যাপন করিতে শিক্ষা পায় এবং নিম্নশ্রেণির লোকদিগকে এমন শিক্ষা দিতে হইবে যেন তাহারা অন্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় কাজে তাহাদের দৈহিক শ্রম নিয়োজিত করিতে পারে। এই মতের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রবাদীরা যে অভিমত পোষণ করেন তাহা কতকটা অস্পষ্ট এবং ঘোলাকে। অভিজাতদের পক্ষে অকেজো শিক্ষা তাহারা অপছন্দ করেন কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে, দিনমজুরদের শিক্ষা যেন কেবল কার্যকরি শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা না হয়। কাজেই বিলাতের পাবলিক স্কুলে প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রদত্ত সাহিত্য প্রধান শিক্ষার বিরোধিতা দেখিতে পাই; আবার সেই সঙ্গে এ দাবিও উত্থাপিত হইয়াছে যে, মজুরদের গ্রিক ও ল্যাটিন শিক্ষার জন্য যেন সুযোগ দান করা হয়। এই নীতির মধ্যে সামান্য অস্পষ্টতা থাকিলেও মূলে সত্য আছে। গণতন্ত্রবাদীরা সমাজকে একটি প্রয়োজনীয় এবং অন্যটি আলঙ্কারিক বা প্রয়োজনীয় এই দুই ভাগে ভাগ করিতে চান না। কাজেই তাঁহারা আলঙ্কারিক শ্রেণিকে অধিক পরিমাণে কেবল কার্যকরি শিক্ষা এবং এ যাবৎ প্রয়োজনীয় শ্রেণিকে অধিক পরিমাণে কেবল আনন্দদায়ক শিক্ষার দিবার পক্ষপাতী। এই দুইটি উপাদান-কার্যকরি শিক্ষা ও আলঙ্কারিক শিক্ষা–কি পরিমাণে মিশাইতে হইবে গণতন্ত্র তাহা নির্ধারণ করিবে।
দ্বিতীয় সমস্যা হইল দু দল লোকের মধ্যে মতবিরোধ। ইহাদের একদল মনে করেন কেবল সংসারের প্রয়োজন মিটানোই শিক্ষার উদ্দেশ্য, অন্য দল শিক্ষার মারফত কেবল মানসিক আনন্দলাভেই পক্ষপাতী। যদি ধনশালী আধুনিক ইংরাজ ও আমেরিকাবাসীদিগকে কোনো জাদুবিদ্যার সাহায্যে এলিজাবেথের যুগে লইয়া যাওয়া যায় তবে স্যার ফিলিপ সিডনির সমাজ, চিত্তহারী সঙ্গীত এবং স্থাপত্যের সৌন্দর্য বর্তমানকালের বাথরুম, চা, কফি, মোটরগাড়ি এবং অন্যান্য বিলাসের উপকরণের অভাব মিটাইতে পারিবে না। নেহাত গোঁড়া সংস্কারে দ্বারা প্রভাবান্বিত না হইলে এরূপ লোকের অধিকাংশের ধারণা এই যে, উৎপাদিত জিনিসের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য বাড়ানোই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। তাহারা ঔষধ এবং স্বাস্থ্যবিদ্যা শিক্ষার অন্তর্গত করিতে পারেন কিন্তু সাহিত্য, শিল্প বা দর্শন সম্বন্ধে তাহাদের কোনো উৎসাহ নাই। রেনেসাঁ যুগে যে সাহিত্যপ্রধান পাঠ্য তালিকা প্রবর্তিত হইয়াছিল তাহার উপর আক্রমণ চালাইতে এরূপ লোকই অগ্রণী হইয়াছেন।