সূচনায় খেলার মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। কার্ল গ্রুস এ সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছেন; পূর্ব অধ্যায়ে উইলিয়াম স্টার্নের যে পুস্তকের কথা উল্লিখিত হইয়াছে তাহাতে কিছু সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা আছে। এ বিষয়ে দুইটি পৃথক প্রশ্ন আছে প্রথমটি, খেলার মূল উৎস কি, সে সম্পর্কে; দ্বিতীয়টি খেলার দৈহিক বা জৈবিক উপযোগিতা সম্পর্কে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি সহজতর। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে পূর্ণ বয়সের প্রাণিদিগকে যে কাজ দৈহিক প্রয়োজনের খাতিরেই করিতে হইবে সকল প্রজাতির [species] শিশুরাই তাহা শৈশবে খেলাচ্ছলে করিয়া থাকে। কুকুর শাবকদের খেলা ঠিক বয়স্ক কুকুরের লড়াইয়ের মতোই, কেবল সত্য সত্যই দাঁত বসাইয়া কামড়ায় না এই যা পার্থক্য। বিড়ালছানাদের খেলা বিড়ালের ইঁদুর ধরিবার কস্রতের অনুরূপ। শিশুরা যাহা দেখে তাহা অনুকরণ করিতে ভালোবাসে, যেমন ইট, পাথর, কাঠের টুকরা প্রভৃতি দিয়া বাড়ি তৈয়ার করা কিংবা গর্ত খনন করা। যে কাজ তাহাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় তাহারা সে কাজই করিতে বেশি পছন্দ করে। যে সব খেলায় শিশুদের মাংসপেশি নূতনভাবে সঞ্চালিত হইবার সুযোগ পায় তাহা তাহাদের নিকট বড়ই আনন্দদায়ক মনে হয়, যেমন–লাফানো মই বা খুঁটি বাহিয়া উপরে ওঠা, সরু তক্তার উপর দিয়া হাঁটা প্রভৃতি; তবে দেখিতে হইবে এ কাজ যেন খুব কঠিন না হয়। ইহা যদিও সাধারণভাবে শিশুর (খেলার আবেগের) ক্রীড়া আবেগের উপযোগিতা প্রমাণ করে, খেলার জন্য তাহার যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত কামনা থাকে, তাহার সম্পূর্ণ প্রকাশ শুধু ইহার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইহার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
কতক মনঃসমীক্ষক শিশুর খেলার ভিতর যৌন প্রতীকতা খুঁজিয়া বাহির করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহা যে সম্পূর্ণ অলীক সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই। শৈশবে শিশুর কার্যকলাপের মধ্যে প্রবৃত্তি-জাত যৌন আবেগ প্রধান নয়, বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার বাসনা কিংবা আরও খাঁটিভাবে বলিলে বলা যায় যে, শক্তিলাভের বাসনাই তখন থাকে প্রবল। বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনায় শিশু তাহার দুর্বলতা বুঝিতে পারে; সে মনে মনে তাহাদের সমকক্ষ হওয়ার বাসনা পোষণ করে। আমার ছেলে যখন বুঝিয়াছিল যে সেও একদিন বয়স্কব্যক্তি হইবে এবং আমি নিজেও একদিন তাহার মতোই ছোট ছিলাম তখন সে অত্যন্ত সুখি হইয়াছিল। কৃতকার্য হওয়া যাইবে এই আশ্বাস মানুষের উদ্যম বৃদ্ধি করে। শিশুদের অনুকরণের অভ্যাস হইতেই দেখা যায় বয়স্ক ব্যক্তিরা যাহা করে শিশুরাও তাহা করিতে চায়; শিশুদের কাজে প্রেরণা জোগাইতে বড় ভাইবোনেরা খুব সাহায্য করে; তাহাদের উদ্দেশ্য কি তাহা শিশুরা সহজে বুঝিতে পারে এবং তাহাদের শক্তিও বয়স্ক লোকের দৈহিক শক্তির মতো বেশি নয় বলিয়া শিশুদের নাগালের সম্পূর্ণ বাহিরে নয়। বয়স্ক লোকের সঙ্গে তুলনায় শিশু নিজেকে যতখানি হীন মনে করে তাহার বড় ভাইবোনের সঙ্গে তুলনা করিয়া ততখানি ছোট মনে করে না। শিশুদের মধ্যে স্বভাবতই হীনতাবোধ খুব বেশি; তাহারা যদি স্বাস্থ্যবান হয় এবং উপযুক্তভাবে শিক্ষা পায় তবে এই হীনতাবোধ তাহাদিগকে চেষ্টায় প্রেরণা দেয়, তাহারা শক্তিমান হইয়া বয়স্কদের সমান হইতে চায় কিন্তু তাহাদিগকে যদি দমন করিয়া রাখা হয় তবে তাহাদের মানসিক অশান্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে।
খেলার ভিতর আমরা দুই প্রকারে শিশুর শক্তি অর্জনের বাসনার প্রকাশ (দুইটি স্বরূপ) দেখিতে পাই : প্রথম, কোনো কাজ শিখিবার চেষ্টায়; দ্বিতীয়, ভান বা কল্পনার আশ্রয় গ্রহণে। যৌনজীবনে ব্যর্থকাম হতাশ যুবক তাহার মনের কামনাগুলি পরিতৃপ্ত করিবার জন্য অনেক সময় জাগ্রত স্বপ্নের আশ্রয় নেয়; বাস্তব জীবনে যাহা পায় না, কল্পনায় তাহাই উপভোগ করিতে আনন্দ পায়। তেমনই স্বাভাবিক সুস্থ শিশু খেলার ভিতর দিয়া এমন ভান করিতে ভালোবাসে যাহাতে সে নিজের দৈহিক শক্তির পরিচয় দিতে পারে। সে দৈত্য, সিংহ কিংবা রেলগাড়ি হইতে চায়, সে এমন প্রাণী সাজিতে চায় বা এমন জিনিসের ভান করা পছন্দ করে যাহাতে অন্যের মনে ভয়ের সঞ্চার করিতে পারে। আমি পুত্রকে দানব নিধনকারী জ্যাকের গল্প বলিয়া তাহাকে জ্যাক সাজিতে বলিলাম কিন্তু সে দানব হওয়ার জন্যই ইচ্ছা প্রকাশ করিল।
সে যখন তাহার মায়ের নিকট ব্লু-বিয়ার্ডের গল্প শোনে তখন ব্লু-বিয়ার্ড হওয়ার জন্য সে পীড়াপীড়ি করিতে থাকে এবং বলে যে অবাধ্য হওয়ার জন্য তাহার স্ত্রীকে শাস্তি দেওয়া ঠিক কাজই হইয়াছে। বু-বিয়ার্ডের ভান করিয়া খেলার সময় সে মহিলাদের মাথা কাটিয়া ফেলে। ফ্রয়েডবাদী মনস্তাত্ত্বিকগণ হয়তো বলিবেন– স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচার করার বাসনা শিশুর মনে লুকাইয়া রহিয়াছে। কামজ প্রেমের বিকৃত অবস্থায় এই প্রকার ধর্ষকাম অর্থাৎ প্রীতির বিপরীত ভাব, নিষ্ঠুরতা দেখা দেয়। মহিলাদিগকে শাস্তি দেওয়ার বাসনা শিশুর ধর্ষকামের পরিচায়ক। কিন্তু সে শুধু মহিলাদিগের মাথা কাটিতেই আনন্দ পায় নাই, ছোট ছোট বালকদিগকে খাইয়া ফেলিয়াছিল যে দৈত্য সেই রূপ দৈত্য সাজিতে কিংবা ভারী ওজনের জিনিস টানিয়া লইয়া যাইতে পারে এমন ইঞ্জিন সাজিতেও অনুরূপ আনন্দ লাভ করিয়াছে। এইসব ভান-ক্রীড়ার মধ্যে শক্তিমান হওয়ার, দৈহিক ক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার বাসনাই ছিল, যৌনবাসনার কোনো প্রকার প্রকাশ ছিল না। একদিন বেড়াইয়া ফিরিবার পথে গল্পচ্ছলে কৌতুক করিয়া ছেলেকে বলিয়াছিলাম, হয়তো বাড়ি গিয়া দেখিব যে ঢিডলিউইংক্স নামে এক অপরিচিত ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি দখল করিয়া রহিয়াছেন; তিনি হয়তো আমাদগিকে বাড়িতে ঢুকিতেই দিবেন না। ইহার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমার ছেলে বাড়িতে ঢুকিতেই দিবেন না। ইহার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমার ছেলে বাড়িতে ঢুকিবার পথের দেওয়ালের উপর দাঁড়াইয়া মিঃ টিডইলিউইংক্স সাজিয়া আমাকে অন্য বাড়িতে যাইতে আদেশ করিত। এই খেলায় তাহার আনন্দের সীমা থাকিত না; এইভাবে যে সে শক্তির পরিচয় দেওয়ার ভান করিত তাহা স্পষ্টই বোঝা যায়।