শিশুকে বুঝাইয়া দিন যে, ইহার মধ্যে কোনো রহস্য নাই। শিশু যদি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হয় এবং স্বাস্থ্যবান হয় তবে সে ইহা লইয়া দুশ্চিন্তা করিয়া মাথা ঘামাইবে না। এ প্রসঙ্গে কথা উঠিলে খোলাখুলিভাবে আপনি যাহা বিশ্বাস করেন তাহা সরলভাবে বলিবেন এবং শিশুর মনে এই ধারণা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিবেন যে, বিষয়টি খুব আনন্দপ্রদ নয়। কি শিশু কি বৃদ্ধ কাহারও পক্ষেই মৃত্যুচিন্তায় সময় কাটানো মঙ্গলজনক নয়।
কোনো কিছু সম্বন্ধে বিশেষ ভয় ছাড়াও শিশুর একটা সাধারণ উত্তষ্ঠা বোধ করিতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের অত্যধিক শাসনই মোটামুটিভাবে এ জন্য দায়ী। কিন্তু বর্তমানে ইহা অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে।
পদে পদে দোষ ত্রুটি ধরা, গোলমাল করিতে নিষেধ করা, সর্বদা ভদ্র আচরণ সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া প্রভৃতি শিশুর জীবন দুঃখময় করিয়া তুলিত। আমার মনে আছে, পাঁচ বৎসর বয়সে আমি শুনিয়াছিলাম যে শৈশবকাল জীবনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুখের কাল (সে যুগে ইহা ছিল নিছক মিথ্যা কথা)। আমি কাঁদিয়া আকুল হইতাম, মনে করিতাম মরিলেই বাঁচি, অবসাদময় বছরগুলি কিভাবে কাটাইব তাহা ভাবিতেই পরিতাম না। কেহ যে শিশুকে এরূপ বলিতে পারেন বর্তমান যুগে তাহা অচিন্ত্যনীয়।
শিশুরা স্বভাবতই আশাবাদী; তাহাদের মন আগামী দিনের স্বপ্ন দেখে, ভবিষ্যতের আশায় উৎসাহিত হয়। ইহা শিশুকে কাজে অনুপ্রেরণা দেয়। শিশুর দৃষ্টি যদি পিছন দিকে ফিরাইয়া দেওয়া যায়, বলা হয় যে ভবিষ্যৎ অতীতের চেয়ে বেশি দুঃখপূর্ণ তবে তাহার জীবনের উৎসকেই নির্জীব ও দুর্বল করিয়া ফেলা হয়। অথচ বাল্যকাল সুখের সময় এই ধরনের কথা বলিয়া হৃদয়হীন ভাবপ্রবণ ব্যক্তিরা শিশুদের জীবন বিষাদময় করিয়া তুলিতেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহাদের কথা শিশুদের জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। প্রায় সময়েই আমার মনে হইত বয়স্ক ব্যক্তিদের পড়াশুনার চাপ নাই, তাহারা যাহা ইচ্ছা তাহাই খাইতে পারেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই খুব সুখি। আমার এই বিশ্বাস ছিল স্বাস্থ্যপ্রদ এবং প্রেরণার উৎসস্বরূপ।
.
লাজুকতা : লাজুকতা বড়ই বিব্রতকর ধরনের ভীরুতা। ইহা ইংল্যান্ড ও চীনদেশে ব্যাপকভাবে দেখা যায়, অন্যত্র খুব কম। ইহার উৎপত্তির আংশিক কারণ হয় অপরিচিত লোকের সংস্পর্শে না আসা এবং আংশিক কারণ সামাজিক আদাব কায়দার উপর জোর দেওয়া। সুবিধা হইলেই শিশুদিগকে প্রথম বৎসরের পর হইতেই অপরিচিত লোক দেখিতে এবং তাহাদের সান্নিধ্যে আসিতে দেওয়া উচিত। আদব-কায়দা সম্বন্ধে বলা চলে, নিম্নতম যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু শিখানো দরকার, প্রথম অবস্থায় শিশু অন্যের নিকট অসহনীয়রূপে বিরক্তিকর না হইলেই হইল। শিশুদিগকে অপরিচিত আগন্তুকের সম্মুখে ঘরের মধ্যে শান্তভাবে বসাইয়া না রাখিয়া বরং কিছুক্ষণ নিজের ইচ্ছামতো থাকিতে দিয়া পরে অন্যত্র লইয়া যাওয়া উচিত। প্রথম দুই বৎসর শিশুর ছবি, কাদামাটি, যন্ত্রপাতি অথবা অন্য কোনো খেলার সরঞ্জাম লইয়া দিনের মধ্যে কিছু সময় নিজের ইচ্ছামতো কাটাইতে অভ্যাস করানো ভালো। শিশুকে শান্ত হইয়া থাকিতে বলিলে তাহার এমন কারণ থাকা চাই যাহা সে বুঝিতে পারে। খেলার মতো প্রীতিকর অভ্যাসের ভিতর দিয়াই ভদ্র আচরণ শিখানো উচিত; নীরস উপদেশ বা তত্ত্বহিসাবে প্রয়োগ করিলে ইহাতে বিশেষ সুফল পাওয়া যাইবে না। যখনই শিশুর বুঝিবার ক্ষমতা হইবে, সে অনুভব করিবে যে তাহার পিতামাতারও অধিকার আছে; সে অন্যকে কাজে স্বাধীনতা দিবে, নিজেও যথাসাধ্য ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে। শিশুরা সহজেই ন্যায় বিচার উপলব্ধি করে; অন্যের নিকট হইতে তাহারা যেরূপ আচরণ পাইবে অন্যের প্রতিও তাহারা দ্রুপ করিতে প্রস্তুত থাকিবে। ইহাই ভদ্র আচরণের মূল।
ভয় নিবারণের উপায় :
সর্বোপরি, আপনি যদি আপনার সন্তানদের ভীতি দূর করিতে ইচ্ছা করেন, আপনি নিজে নির্ভীক হউন। আপনি যদি মেঘগর্জনে ভয় পান, তবে প্রথমবার যখন আপনার শিশু আপনার সম্মুখে থাকিয়া মেঘ গর্জন শুনিবে, তখনই তাহার মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হইবে। আপনি যদি সামাজিক বিপ্লব সম্পর্কে ভীতি প্রকাশ করেন, আপনি কি বিষয়ে বলিতেছেন তাহা বুঝিতে না পারায় আপনার সন্তান আরও বেশি ভীত হইবে। আপনি যদি রোগ সম্বন্ধে শঙ্কিত হন আপনার সন্তান আরও বেশি শঙ্কিত হইবে। জীবন বিঘ্ন-সংকুল কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তি অবশ্যম্ভাবী বিপদকে উপেক্ষা করেন এবং যেগুলি প্রতিরোধ করা সম্ভব সেগুলি সম্বন্ধে বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া অবিচলিতভাবে কাজ করেন। আপনি মৃত্যুর হাত এড়াইতে পারেন না কিন্তু বিনা উইলে মৃত্যুর হাত এড়াইতে পারেন। কাজেই আপনার উইল (দানপত্র) করিয়া ফেলুন তারপর মনে ভুলিয়া যান যে আপনি মরণশীল। বাস্তব দুর্ভাগ্য বা দৈব-দুর্বিপাকের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা ভয় হইতে সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস; ইহা বিজ্ঞতার পরিচায়ক, কিন্তু ভীতি আত্ম অমর্যাদাকর। আপনি যদি নিজের ভয় দমন করিতে না পারেন তবে চেষ্টা করিবেন যাহাতে আপনার সন্তান ইহা সন্দেহ করিতে না পারে। সর্বোপরি তাহাকে এমন উদার দৃষ্টিভঙ্গি দিবেন এবং তাহার মনে বহুবিচিত্র বিষয়ে এমন জীবন্ত উৎসাহ সঞ্চার করুন যেন সে পরবর্তী জীবনে নিজের ব্যক্তিগত বিপদের আশঙ্কা সম্বন্ধে চিন্তা না করে। কেবল এই উপায়েই আপনি তাহাকে বিশ্বের একজন মুক্ত নাগরিকরূপে গড়িয়া তুলিতে পারেন।
০৫. খেলা ও কল্পনা
কি মনুষ্য, কি কি মনুষ্যেতর প্রাণী সকলের সন্তানই খেলা ভালোবাসে। মানব শিশুরা খেলার ভিতর দিয়া নানারূপ ভান করিয়া অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করে। খেলা এবং তাহার ভিতর দিয়া নানা কাজের ভান শিশুর সুখ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়, এইরূপ খেলার অন্য কোনো উপকারিতার কথা চিন্তা না করিলেও শুধু শিশুর স্বাভাবিক এবং সুস্থভাবে বৃদ্ধির জন্যও ইহা প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে দুইটি বিষয় চিন্তা করিবার আছে : প্রথম, শিশুর খেলার সুযোগদানের জন্য পিতামাতা এবং স্কুল কি করিবেন? দ্বিতীয়, খেলার শিক্ষাসম্বন্ধীয় উপকারিতা বৃদ্ধি করিবার জন্য তাহাদিগকে কি আরও বেশি কিছু করিতে হইবে?