যে ধরনের ভয়ের সহিত আমি পরিচিত, স্বর্গত ডক্টর রিভার্স তাঁহার প্রকৃতি ও নির্জন মন [Instinct and the Onconscious] পুস্তকে চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়াছেন। তিনি বলেন, কোনো বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখিন হইবার একটি উপায় হইল দৈহিক পটুতা এবং যাহারা ইহা উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করিতে পারে তাহারা অন্তত সজ্ঞানে ভয় অনুভব করে না। এইরূপ অভিজ্ঞতার যথেষ্ট মূল্য আছে; ইহা আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করে এবং ভয়কে জয় করিবার কৌশল আয়ত্ত করিতে উৎসাহ দেয়। সাইকেল চালানো শিখিবার মতো সহজ কৌশলও বালকের মনে এইরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে। বর্তমান জগতে যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসারের জন্য এই ধরনের কৌশল আয়ত্ত করার প্রয়োজন দিন দিন বাড়িতেছে।
আমার অভিমত এই যে, অন্য লোকের সহিত দৈহিক কসরতের ভিতর দিয়া সাহস অর্জন অপেক্ষা নানা কলকজা আয়ত্ত করার মতো দৈহিক পটুতা শিক্ষা করানো বেশি প্রয়োজনীয়। পর্বত আরোহণে, উড়োজাহাজ চালনায় কিংবা ঝড়ের মধ্যে ছোট একটি জাহাজ চালাইতে যে প্রকার সাহস দরকার তাহা আমার নিকট যুদ্ধ করিতে যেরূপ সাহস দরকার তাহা অপেক্ষা বেশি প্রশংসার যোগ্য মনে হয়। কাজেই আমি স্কুলের ছাত্রদিগকে ফুটবল খেলার দিকে ঝোঁক দিতে না দিয়া কমবেশি রকমের বিপজ্জনক বিষয়ে নিপুণতা শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী। যদি কোনো শত্রুকেই অভিভূত করিতে হয়, এই শত্ৰু মানুষ না হইয়া কোনো বস্তু হোক, ইহাই বাঞ্ছনীয়। এ নীতি শুধু কাগজ-কলমে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখিলেই চলিবে না, শরীরচর্চা ও ক্রীড়া কৌশলের ক্ষেত্রে ইহার গুরুত্ব বৃদ্ধি করিতে হইবে।
দৈহিক সাহস দেখানোর আরও নিষ্ক্রিয় (Passive] উপায়ও আছে। কোনো রকম হইচই আহা-উঁহু না করিয়া আঘাত সহ্য করা ইহার একটি দৃষ্টান্ত। ছোটখাটো আঘাত পাইলে শিশুদের প্রতি যদি সমবেদনা না দেখানো হয়, তবে এই ধরনের সাহস গড়িয়া তোলা যায়। পরবর্তীকালে অত্যধিক সমবেদনা পাওয়ার বাসনা হইতে নানা উত্তেজনাময় বায়ুরোগের কারণ ঘটিতে পারে। লোকে একটু আদর আপ্যায়ন, একটু আঁচড় লাগিলে বা কাটিয়া গেলেই শিশুদিগকে কাঁদিতে উৎসাহ না দিলে এইরূপ মনোভাব প্রতিরোধ করা যায়। এই ব্যাপারে বালকদের প্রতি যেমন অতি মৃদু ও কোমল ব্যবহার সঙ্গত নয়, বালিকাদের প্রতিও তেমনই। স্ত্রীলোকেরা যদি পুরুষের সমকক্ষ হইতে চায় তবে চরিত্রের দৃঢ় গুণগুলির বিষয়েই বা তাহারা পুরুষ অপেক্ষা হীন হইবে কেন?
যে সাহস কেবল দৈহিক নয় এখন সেই ধরনের সাহসের আলোচনা করা যাক। এই প্রকার সাহসই বিশেষ প্রয়োজনীয় কিন্তু কোনো প্রাথমিক ধরনের সাহসকে ভিত্তি না করিয়া ইহা গড়িয়া তোলা কঠিন। অবাস্তব ভয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে রহস্যজনক জিনিসের প্রতি ভয়ের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। আমার বিশ্বাস এই যে, ভয় প্রবৃত্তি হইতে সমুৎপন্ন এবং ইহার ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব বেশি। ইহাই অধিকাংশ কুসংস্কারের কারণ। চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, ভূমিকম্প, প্লেগ এবং অনুরূপ ঘটনা অশিক্ষিত লোকের মধ্যে রীতিমত ভয় উদ্রেক করে। ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে এ ভীতি বড়ই বিপজ্জনক, কাজেই প্রথম জীবনেই ইহা সমূলে উৎপাটন করা বাঞ্ছনীয়। এ ভীতির প্রধান ঔষধ হইল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। প্রথম দৃষ্টিতে যাহা রহস্যজনক তাহারই যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কতকগুলি ব্যাখ্যা দিলে শিশু অনুমান করিবে যে অন্য ঘটনারও অনুরূপ কারণ আছে এবং ইহা বলা সম্ভবপর হইবে যে, এখনও ব্যাখ্যা দেওয়া যাইতেছে না। কোনো কিছুর রহস্য যে অজ্ঞতা হইতেই উদ্ভূত এবং ধৈর্য ও মানসিক চেষ্টা দ্বারা যে এই অজ্ঞতা দূর করা যায় এই ধারণা যত শীঘ্র জন্মান যায় ততই মঙ্গল। ইহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, যে-রহস্য প্রথমে শিশুর ভীতি উৎপাদন করে তাহার কারণ জানা হইয়া গেলে তাহাই আবার শিশুকে আনন্দ দেয়। এইভাবে দেখা যায়, যখনই রহস্য আর কুসংস্কার বৃদ্ধি করে না তখন হইতেই ইহা শিশুর পাঠের অনুপ্রেরণা জোগায়। আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে একাকী তন্ময় হইয়া বহু ঘণ্টা ধরিয়া বাগানের পিচকারিটি পরীক্ষা করিয়াছে। অবশেষে সে বুঝিতে পারে কিভাবে জল ভিতরে আসে এবং বাতাস বাহির হইয়া যায় এবং কীভাবে ইহার বিপরীত অবস্থা ঘটে অর্থাৎ জল বাহির হইয়া গেলে বাতাস প্রবেশ করে। ছোট ছেলেমেয়েরাও যাহাতে বুঝিতে পারে এমনভাবে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ বুঝাইয়া বলা যায়। শিশুরা যাহা দেখিয়া ভয় পায় বা আনন্দ পায় তাহা সম্ভবপর হইলে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া উচিত।
এই সংক্রান্ত কতকগুলি সমস্যা বেশ কঠিন। ইহাদের ব্যাখ্যা করিয়া শিশুদিগকে বুঝাইয়া দিতে রীতিমত কৌশলের প্রয়োজন। ইহাদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হইল মৃত্যু রহস্য। শিশু দেখে যে, গাছপালা এবং জীবজন্তু মরিয়া যায়। তাহার ছয় বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই হয়তো তাহার পরিচিত ব্যক্তির মৃত্যু হইতে পারে। তাহার মন যদি সক্রিয় হয় তবে তাহার মনে হইতে পারে যে তাহার পিতামাতারও একদিন মৃত্যু হইবে। এমনকি সে নিজেও মরিবে। (নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা চিন্তা করা কঠিন)। এই চিন্তাগুলি তাহার মনে বহু প্রশ্ন তুলিবে; এগুলির উত্তর দেওয়া আবশ্যক। যিনি পরলোক বিশ্বাস করেন তাঁহার পক্ষে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিথঞ্চিৎ সহজ। কিন্তু যিনি বিশ্বাস করেন না তিনিও যেন নিজের বিশ্বাসের বিপরীত কোনো অভিমত না দেন। পিতামাতার পক্ষে শিশুর নিকট মিথ্যা বলিবার কোনো সঙ্গত কারণ নাই। ইহা বলাই সবচেয়ে ভালো যে, মৃত্যু হইল মহান্দ্রিা; মৃত্যুঘুমে ঘুমাইয়া পড়িলে কেহ আর জাগিয়া ওঠে না। কোনোরূপ গাম্ভীর্যের অবতারণা না করিয়া এমনভাবে বলুন যে, মৃত্যু একটি সাধারণ ঘটনা। শিশু যদি নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে চিন্তাকুল হয় তাহাকে বলুন যে, অনেকদিন পর্যন্ত তাহার পক্ষে মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা নাই। দুঃখপূর্ণ হইলেও মৃত্যু অনিবার্য এবং ইহার কষ্ট সহ্য করিতেই হইবে। মৃত্যু সম্বন্ধে এই ধরনের ভাব বাল্যকালে শিশুর মনে সঞ্চার করার চেষ্টা বৃথা। আপনি নিজে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিবেন না কিন্তু শিশু জানিতে চাহিলে প্রশ্ন এড়াইয়া যাইবেন না।