এই ব্যাপারে এই রকম বয়সে আমার উপর যে প্রণালী প্রয়োগ করা হইয়াছিল তাহা অদ্ভুত। গোড়ালি ধরিয়া উঁচু করিয়া আমার মাথা জলের মধ্যে ডুবাইয়া দেওয়া হইত, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইহার ফলে সমুদ্রের জল আমি ভালোবাসিতে আরম্ভ করি। তথাপি এ প্রক্রিয়া আমি অন্যের জন্য অনুমোদন করি না।
এ কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইল, কারণ যে বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে আমার বিশেষ আস্থা আছে ইহা কতকাংশে তাহার বিরুদ্ধে গিয়াছে। শিক্ষাক্ষেত্রে জোর প্রয়োগ না করাই ভালো। কিন্তু আমার মনে হয় ভয় জয় করিতে কিছুটা জোর জবরদস্তি সুফল দেয়। কোনো অবাস্তব ভয় যদি প্রবল হয় শিশুর নিজের উপর ছাড়িয়া দিলে সে কখনোই পরীক্ষা করিয়া দেখিবে না বাস্তবিক সে-ভয়ের কোনো প্রকৃত হেতু আছে কি না। যাহা পূর্বে বিপজ্জনক মনে হইয়াছিল এরূপ ঘটনা যদি বারে বারে অনুষ্ঠিত হয় অথচ কোনো বিপদ না ঘটে তবে ইহার সঙ্গে শিশুর পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ই ভয় নাশ করে। এই ভীতিনাশক অভিজ্ঞতা কেবল একবার দিলেই চলিবে না; বারংবার ঘটাইতে হইবে যেন ইহার সম্বন্ধে কোনো ভয়ই আর না থাকে। কোনো প্রকার জোর না করিয়া যদি এরূপ অভিজ্ঞতা দেওয়া যায় তবে ভালোই, তাহা যদি সম্ভব না হয় তবে অপরাজিত ভয় পোষণ করা অপেক্ষা জোর করিয়া দূর করাই শ্রেয়।
আরও একটি বিষয় আছে। আমার ছেলের ক্ষেত্রে এবং মনে হয় অন্য সকলের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়াছে যে ভয়কে জয় করার আনন্দ অপরিসীম। বালকের গর্ববোধ জাগানো সহজ; সাহস দেখানোর জন্য প্রশংসা পাইলে সারাদিন সে আনন্দে উৎফুল্ল থাকে। পরবর্তী বয়সে ভীরু ছেলেরা অন্য সকলের ঘৃণার পাত্র হইয়া মানসিক কষ্ট বোধ করে কিন্তু তখন তাহাদের পক্ষে নূতন অভ্যাস গঠন করাও কঠিন। এইজন্য আমার মনে হয় অল্প বয়স হইতেই ভয় দমন করার ব্যাপারে আত্মসংযম অভ্যাস এবং দৈহিক পটুতা [Enterprise] শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ জন্য যদি কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হয় তাহাও বরং বাঞ্ছনীয়।
পিতামাতা তাহাদের ভুল হইতে শিক্ষালাভ করেন। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হইয়া উঠে তখনই তাঁহারা নিজেদের ভুল বুঝিতে পারেন এবং কিভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল তাহাও উপলব্ধি করিতে পারেন। ছেলেকে অতিরিক্ত আদর দিলে কি কুফল ফলে তাহার একটি উদাহরণ উল্লেখ করিব। আমার ছেলের বয়স যখন আড়াই বৎসর তখন তাহাকে একটি কুঠুরিতে একা একা শুইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। পরিচারিকার তত্ত্বাবধানে শিশুর শয়ন-ঘর হইতে অন্যত্র শুইতে পাওয়ায় পদোন্নতির গর্বে সে খুবই আনন্দিত হইয়াছিল এবং প্রথম প্রথম সারারাত্রি নির্বিঘ্নে ঘুমাইয়া কাটাইত। এক রাত্রিতে খুব জোরে ঝড় বহিতেছিল, ভীষণ শব্দ করিয়া জানালার একটি খিল খুলিয়া গিয়াছিল। ভয়ে জাগিয়া উঠিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিল। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার কক্ষে গিয়াছিলাম সে হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়াছিল; সে আমার কণ্ঠলগ্ন হইয়া শুইয়া রহিল; দ্রুততালে তাহার হৃৎস্পন্দন হইতেছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার ভয় দূর হইল কিন্তু আলো না থাকায় অনুযোগ করিতে লাগিল। অথচ ওই সময় সে সারারাত্রি অন্ধকার ঘরে ঘুমাইত। তাহাকে রাখিয়া আসার পর আবার সে ভয়ের কথা বলে। কাজেই তাহাকে একটি আলো দেওয়া হইল। ইহার পর সে প্রায় প্রতি রাত্রিতেই চিৎকার করিয়া উঠিত, পরে বোঝা গেল ইহার উদ্দেশ্য শুধু এই যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা আসিয়া তাহাকে লইয়া কিছুটা হইচই করুক। কাজেই আমরা তাহাকে শান্তভাবে বুঝাইয়া বলিলাম যে, অন্ধকারে ভয়ের কিছুই নাই এবং ঘুম ভাঙিয়া গেলে সে যেন পাশ ফিরিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়ে। কোনো গুরুতর কিছু না ঘটিলে যে আমরা তাহার কাছে রাত্রিতে আর যাইব নাতাহাও জানাইয়া দিলাম। সে মনোযোগ দিয়া শুনিল এবং তারপর হইতে বিশেষ কারণ ছাড়া আর রাত্রিতে কাঁদিয়া ওঠে নাই। রাত্রিতে ঘরে আলো রাখা অবশ্য বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। আমরা যদি আরও বেশি আদর দেখাইতাম তবে হয়তো কিছুকাল, শুধু কিছুকাল কেন হয়তো বরাবরই তাহার ঘুমের ব্যাঘাত করিতাম।
এই গেল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। আমরা এখন ভয় দূর করার সাধারণ প্রণালী সম্বন্ধে আলোচনা করিব।
প্রথম কয়েক বৎসরের দৈহিক সাহস শিক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত শিক্ষক হইল অন্য শিশুরা। যদি শিশুর বড় ভাইবোন থাকে তাহারাই উদাহরণ দেখাইয়া বা উপদেশ দিয়া উহাকে উৎসাহিত করিবে; তাহারা যাহা করিতে পারে শিশুও তাহা অনুকরণ করিবে। স্কুলে দৈহিক ভীরুতাকে সকলেই অবজ্ঞা করে; বয়স্ক শিশুদের এ বিষয়ে আর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নাই। বালকদের মধ্যে অন্তত এই ভাবই প্রচলিত। মেয়েদের মধ্যেও এইরূপ হওয়া উচিত, তাহাদেরও ছেলেদের মতো সাহস থাকা বাঞ্ছনীয়। সৌভাগ্যক্রমে বালিকাদিগকে এখন আর মেয়েলি শিক্ষা দেওয়া হয় না এবং তাহাদের দৈহিক শক্তি বিকাশের পূর্ণ সুযোগ তাহারা পায়। তথাপি বালক ও বালিকাদের মধ্যে এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ পার্থক্য রহিয়াছে। আমার বিশ্বাস এই যে, এইরূপ পার্থক্য থাকা উচিত নয়। আমি যখন সাহস বাঞ্ছনীয় মনে করিয়াছি তখন সাহসের আচরণমূলক ব্যাখ্যাই আমার মনে আসিয়াছে। অন্যেরা যে কাজ ভয়ে করিতে পারে না সে কাজ যে করে তাহাকে সাহসী বলা যায়। সে যদি মোটেই ভয় না করে তাহা হইলে সবচেয়ে ভালো; শুধু ভয়কে দমন করাকেই আমি সত্যিকারের সাহস কিংবা শ্রেষ্ঠ সাহস বলি না। বর্তমান নৈতিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হইল–যাহাতে বালক-বালিকা বাঞ্ছনীয় আচরণ করে সে জন্য তাহাদের সদভ্যাস গঠন। ইহাই পূর্বে আত্ম-সংযম এবং ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে করানো হইত। ইচ্ছা শক্তির দ্বারা যে সাহস প্রদর্শিত হয় তাহা স্নায়বিক বিকলতা সৃষ্টি করে। যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের গোলা-ভীতি [Shell Shock] দ্বারা সৃষ্ট মনোবিকলতার বহু দৃষ্টান্ত আছে। যে-ভয় দমিত হইয়াছিল তাহাই পরে এমন নৃতনরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল যে, মনঃসমীক্ষণ দ্বারা তাহা নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় নাই। আমি এ কথা বলিতে চাহি না যে, আত্ম-সংযমের কোনো প্রয়োজন নাই; বরং এ কথা ঠিক যে, আত্ম-সংযম ব্যতীত পূর্বাপর সামঞ্জস্য রাখিযা জীবনধারণ করাই অসম্ভব। আমার বক্তব্য এই যে, এরূপ অবস্থার সম্মুখিন হইবার জন্য পূর্ব হইতে শিক্ষা দেওয়া হয় নাই। শুধু সেইরূপ অভাবিত বা অদৃষ্টপূর্ব অবস্থায় উপযুক্ত আচরণের জন্য আত্ম-সংযমের ব্যবহার প্রয়োজন। সকলকে সবরকম বিপদের সম্মুখিন হইবার মতো শিক্ষা দেওয়াও সম্ভবপর নয়। রাজ্যের সকল অধিবাসীকে যুদ্ধের সময় কিরূপ সাহস প্রদর্শন করিতে হইবে তাহা শিখাইতে যাওয়া মূর্খতারই শামিল। যুদ্ধের ন্যায় সর্বাত্মক বিপদ স্বল্পকাল স্থায়ী এবং কদাচিৎ ঘটিতে থাকে; কাজেই যুবকদিগকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিক্ষার মধ্যে কিরূপ আচরণ করিতে হইবে তাহা অভ্যাস করাইতে গেলে অন্য সকল রকম শিক্ষা খর্ব করিতে হয়।