দুইটি ক্ষেত্রে বাস্তব ভয় সম্বন্ধে আমরা ঠিক ইহার বিপরীত প্রণালী অবলম্বন করিয়াছিলাম। হয়তো ইহা ভুলই হইয়াছিল। তখন প্রত্যক্ষ ভয়ের কারণ বিদ্যমান ছিল না। বৎসরের অর্ধেকটা আমি কোনো পাহাড়ময় সাগরতীরে কাটাই। ছেলেটির উচ্চতা সম্বন্ধে কোনোরূপ ভীতি ছিল না এবং না ঠেকাইলে সে খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠিয়া যাইত। একদিন আমরা একটি খাড়া পাহাড়ের উপর বসিয়াছিলাম; সমুদ্রের জল হইতে ইহা প্রায় একশত ফুট উচ্চে। ছেলেকে শান্তভাবে এই বৈজ্ঞানিক তথ্য বলিলাম : যদি পাহাড়ের ধারে যাও নিচে পড়ে যাবে; পড়ে গেলে প্লেটের মতো ভেঙে যাবে। (সে কয়েকদিন আগে একখানা প্লেট মেঝেতে পড়িয়া ভাঙিয়া যাইতে দেখিয়াছিল) কিছুক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া সে নিজে নিজে উচ্চারণ করিল পড়ে যাবে, ভেঙে যাবে। তাহার পর সে সেইখান হইতে তাহাকে সরাইয়া আনিতে বলে। এ ঘটনা ঘটে তখন তাহার বয়স প্রায় আড়াই বৎসর। ইহার পর হইতে আমরা লক্ষ রাখিলে সে খুব উঁচুতে উঠিত না। কিন্তু কাছে কেহ না থাকিলে বিপদ সম্বন্ধে তাহার কোনো হুঁশ থাকিত na। তাহার বয়স যখন তিন বৎসর নয় মাস তখনই নিঃসঙ্কোচে ছয় ফুট উচ্চ হইতে লাফাইত। বারণ না করিলে কুড়ি ফুট উচ্চ স্থান হইতে লাফ দিতেও সে প্রস্তুত ছিল। কাজেই দেখা যাইতেছে যে, ভয় সম্বন্ধে শিক্ষাদান বিশেষ কার্যকরি হয় নাই। ইহার কারণ আমার নিকট এই মনে হয় যে, উচ্চস্থান হইতে পতনের ভয় সম্বন্ধে শুধু শিক্ষাদান করা হইয়াছিল, ভয় সঞ্চার করা হয় নাই। যখন উপদেশ দেওয়া হইতেছিল, তখন আমাদের দুইজনের মধ্যে কেহই ভয় অনুভব করি নাই। শিক্ষা ব্যাপারে ইহার গুরুত্ব খুব বেশি। বাস্তব বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা থাকা দরকার; ভয় থাকার কোনো প্রয়োজন নাই। কিছুমাত্রায় ভয়ের সঙ্গে মিশ্রিত না থাকিলে শিশু বিপদের আশঙ্কা অনুভব করিতে পারে না; কিন্তু উপদেষ্টা বা শিক্ষকের মধ্যে এই ভয়ের সামান্য প্রকাশ না থাকিলে শিশুর মনে ইহা কোনো রেখাপাত করে না। শিশুর তত্ত্বাবধানকারী বয়স্ক ব্যক্তিদের কখনোই ভীত হওয়া উচিত নয়, এই কারণেই পুরুষের মধ্যে যেমন স্ত্রীলোকদের মধ্যেও তেমনই সাহস বাড়ানো প্রয়োজন।
দ্বিতীয় উদাহরণটি ততটা ইচ্ছাকৃত নয়। খোকার বয়স যখন তিন বৎসর চার মাস একদিন তাহাকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে গিয়া পথে একটি বিষধর সাপ দেখিতে পাই। খোকা পূর্বে সাপের ছবি দেখিয়াছিল কিন্তু আসল সাপ দেখে নাই। সাপ যে কামড়ায় তাহা সে জানিত না। সাপ দেখিয়া সে খুশি হইয়া উঠিল। এবং সেটি চলিয়া গেলে তাহার পিছে পিছে দৌড়াইতে লাগিল। আমি জানিতাম যে সে সাপের কাছে দৌড়াইয়া পৌঁছিতে পারিবে না; কাজেই তাহাকে বারণ করি নাই এবং সাপ যে বিপজ্জনক তাহাও বলি নাই। এই ঘটনার পর হইতে তাহার পরিচারিকা লম্বা ঘাসের মধ্যে সাপ থাকিতে পারে এই ভয়ে তাহাকে দৌড়াদৌড়ি করিতে দিত না। ইহার ফলে খোকার মনে সামান্য ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল, কিন্তু তাহা খুব বেশি নয়।
সমুদ্রের ভয় দূর করাই ছিল সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। খোকার যখন আড়াই বৎসর বয়স তখন তাহাকে প্রথমবার সমুদ্রের জলে নামাইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। প্রথমে ইহা একেবারেই অসম্ভব ছিল। ঠাণ্ডা জল সে মোটেই পছন্দ করিত না, ঢেউ-এর গর্জন শুনিয়া সে ভয়ে জড়সড় হইয়াছিল; তাহার মনে হইতেছিল সমুদ্র কেবলই আসিতেছে, ফিরিয়া যাইতেছে না। ঢেউ বড় থাকিলে সে সমুদ্রের কাছে যাইতেই চাহিত না। এটা ছিল সাধারণভাবে ভয় পাওয়ার কাল। জীবজন্তু, উচ্চ বিকট শব্দ এবং বিভিন্ন জিনিস তাহার ভয় উৎপাদন করিত। সমুদ্রের ভয় আবার অল্প অল্প করিয়া দূর করিয়াছিলাম। প্রথমে শিশুকে সমুদ্র হইতে কিছুটা দূরে অগভীর ডোবার মধ্যে বসাইয়া রাখা হইত ও ঠাণ্ডার ভয় এইভাবে কাটিয়া গিয়াছিল। গরম চার মাসের শেষ দিকে সে এই ডোবার মধ্যে হাঁটিয়া আনন্দ পাইত কিন্তু কোমর পর্যন্ত জলে নামাইলে চিৎকার করিতে থাকিত। সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় অথচ ঢেউ দেখা যায় না এমন স্থানে প্রত্যহ এক ঘণ্টা করিয়া তাহাকে খেলিতে দেওয়া হইত। ভাইবোনদিগকে সমুদ্রে স্নান করিতে দেখিত। ইহার পর আমরা তাহাকে এমন জায়গায় লইয়া যাইতাম যে স্থান হইতে সাগর দেখা যাইত, তাহাকে দেখানো হইত যে, ঢেউ আসিয়া আবার চলিয়া যাইতেছে। এইভাবে তাহার সাগর গর্জন ভীতি দূর করা হইল। ইহা ছাড়া সে তাহার পিতামাতা ও অন্যান্য ভাইবোনকে সমুদ্রে স্নান করিতে দেখিত।
এ সবের ফলে এইমাত্র হইল যে খোকা নির্ভয়ে ঢেউ-এর নিকটে যাইত মাত্র। এ ক্ষেত্রে ইহা নিশ্চিত যে ভয় প্রবৃত্তি হইতে সঞ্জাত; অন্যের নিকট হইত সঞ্চারিত হইবার কোনো কারণ ছিল না। পরের বছর গ্রীষ্মকালে আবার সমুদ্র স্নান শুরু হইল। তখন তাহার বয়স সাড়ে তিন বৎসর। তখনও ঢেউ-এর মধ্যে যাইতে তাহার রীতিমত ভয় ছিল। মিষ্টি কথায় যখন কোনো ফল হইল না, অন্য সকলের স্নান করা দেখিয়াও যখন খোকার জলে নামিতে সাহস হইল না, তখন আমরা। পুরনো প্রণালী গ্রহণ করিলাম। তাহাকে বুঝিতে দিলাম যে তাহার ভীরুতা দেখিয়া আমরা লজ্জা বোধ করি এবং তাহার সাহস দেখিলে প্রশংসা করি। প্রায় এক পক্ষকাল ধরিয়া প্রত্যেক দিন তাহার ধস্তাধস্তি এবং চিৎকার সত্ত্বেও তাহাকে গলা পর্যন্ত জলে ডুবাইয়া রাখা হইত। দিন দিন চিৎকার এবং হাত পা-ছোঁড়া কমিয়া আসিতে লাগিল। ভয় সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হওয়ার আগেই সে জলে নামিতে চাহিত। এক পক্ষ শেষে বাঞ্চিত ফল পাওয়া গিয়াছিল–সে আর সমুদ্র দেখিয়া ভয় পাইত না। সেই সময় হইতে আমরা তাহাকে সম্পূর্ণভাবে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম; আবহাওয়া ভালো থাকিলে নিজের খুশিমতো সে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে স্নান করিত। প্রথমে ভয় সম্পূর্ণভাবে লোপ পায় নাই; গর্ব ইহাকে আংশিকভাবে চাপিয়া রাখিয়াছিল। পরিচয়ের ফলে ভয় কমিতে কমিতে অবশেষে সম্পূর্ণ লোপ পায়। তাহার কুড়ি মাস বয়স্ক ছোট বোন সমুদ্রকে মোটেই ভয় করে না এবং নিঃসঙ্কোচে দৌড়াইয়া জলে নামিয়া পড়ে।