এই বিষয়ে নূতন তথ্য পাইবার আশায় আমি আমার ছেলেমেয়েদিগকে সযত্নে পর্যবেক্ষণ করিয়াছি। কিন্তু ধাত্রী এবং পরিচারিকারা কখন তাহাদিগকে কি বলিয়াছে তাহা সর্বদা জানিতে পারি নাই। এইজন্য ঘটনার বিশ্লেষণও কখনও সন্দেহজনক হইয়াছে। যতদূর বিচার করিতে পারিয়াছি তাহাতে মনে হয় শিশুর প্রথম বছরে ভয় সম্বন্ধে ডক্টর ওয়াটসন যাহা বলিয়াছেন তাহাই ঠিক; আমার ছেলেমেয়েদের বেলায় ইহা পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে। দ্বিতীয় বৎসরে তাহারা কোনো প্রাণী দেখিয়া ভয় পাইত না, কেবল একজন কিছুকাল ঘোড়া দেখিলেই ভীত হইত। ইহার কারণ বোধহয় যে, একদিন একটি খুব জোরে শব্দ করিয়া তাহার পাশ দিয়া ছুটিয়া গিয়াছিল। এই মেয়েটির বয়স এখন দুই বৎসর; ইহার পরবর্তী বয়সে ভয়ের প্রকাশ কেমন তাহা লক্ষ করিবার জন্য ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করিতে হইয়াছে। দুই বৎসর পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি এ ছেলেটির জন্য একজন নূতন ধাত্রী নিযুক্ত করা হয়। এ ধাত্রীটি ছিল ভিতু প্রকৃতির, বিশেষ করিয়া অন্ধকারকে অত্যন্ত ভয় করিত। ছেলেটির মধ্যে অল্পদিনেই এ ভয় সংক্রামিত হইল (প্রথম অবশ্য আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই); সে কুকুর বিড়াল দেখিলে ছুটিয়া পলাইত, কালো কাবোর্ড দেখিলে ভয়ে জড়সড় হইত। অন্ধকার ঘরের প্রত্যেক অংশে আলো চাহিত, এমনকি প্রথমবার তাহার ছোট বোনটিকে দেখিয়া রীতিমতো ভয় পাইয়াছিল; হয়তো সে ইহাকে কোনো অজানা অদ্ভুত প্রাণী মনে করিয়াছিল। [প্রথম কলের পুতুল দেখিলে যেরূপ ভয় হয় এমনও হইতে পারে। সে যখন প্রথম দেখে তখন মেয়েটি ঘুমাইতেছিল; সে ইহাকে কলের পুতুল মনে করিয়াছিল; মেয়েটি যখন নড়িয়াছিল অমনি সে চমকিয়া উঠিয়াছিল।
ছেলেটি হয়তো এই ভয় ভিতু ধাত্রীর নিকট হইতে লাভ করিয়াছিল; বস্তুত ধাত্রী চলিয়া যাওয়ার পর ভয়ও ধীরে ধীরে লোপ পাইয়াছিল। কিন্তু অন্য ধরনের ভয়ও ছিল। এরূপ ভয় ধাত্রী আসিবার পূর্বে প্রকাশ পাইয়াছিল; তাহা ছাড়া কোনো বয়স্ক ব্যক্তি এরূপ ভয় বোধ করিবে না। কাজেই অন্যের নিকট হইতে সঞ্চারিত হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। এরূপ ভয়ের মধ্যে প্রধান হইল যাহা কিছু অদ্ভুতভাবে চলে তাহার প্রতি ভয়, যেমন ছায়া ও খেলনা কলের পুতুল। ইহা পর্যবেক্ষণ করিয়া আমি বুঝিলাম যে, এই ধরনের ভয় শিশুর পক্ষে স্বাভাবিক এবং এগুলি প্রবৃত্তি হইতে উদ্ভূত মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। উইলিয়াম স্টার্ন তাহার Psychology of Early Childhood (শৈশবের মনস্তত্ত্ব) পুস্তকে রহস্যজনক বস্তুর প্রতি ভয় [Fear of the mysterious] শীর্ষক নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন :
পূর্ববর্তী শিশু-মনোবিজ্ঞানবিদগণ এই ধরনের ভয়ের কথা, বিশেষ করিয়া অতি শৈশবে এরূপ ভয়ের স্বরূপ কি তাহা আলোচনা করেন নাই। পরে গ্রুস এবং তাঁহার সঙ্গে আমরা ইহার স্বরূপ জানিতে পারিয়াছি। জানা বিপদের ভয় অপেক্ষা অপরিচিত বিষয়ের ভয়ই বেশি স্বভাবগত বলিয়া মনে হয়। শিশু যদি এমন কোনো জিনিস দেখিতে পায় যাহা তাহার পরিচিত ধারণার সঙ্গে মেলে না তবে তিন প্রকার প্রতিক্রিয়া হইতে পারে। যথা–(১) নূতন জিনিসটি এত অপরিচিত মনে হইবে যে, ইহার প্রতি সে মোটেই আকৃষ্ট হইবে না। (২) কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেও তাহার মনে বিপর্যয় সৃষ্টি করিতে পারিবে না। তখন ইহার মনে জাগ্রত হইবে বিস্ময়, জানিবার বাসনা, নানা চিন্তা, বিচার এবং অনুসন্ধানের মনোভাব। (৩) অথবা নূতন জিনিস তাহার পূর্বের ধারণাকে সম্পূর্ণ উলটাইয়া দিয়া তাহার মনে গভীর অসন্তোষ ও অজানার প্রতি ভয়ের ভাব সৃষ্টি করিবে। গ্রুস বিশেষ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়া বলিয়াছেন যে, এই অজানার প্রতি ভীতি প্রবৃত্তিজাত ভয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, জীবকুলের আত্মরক্ষার পক্ষে প্রয়োজনীয় বলিয়াই ইহা এক প্রজাতি [Grneration] হইতে অন্য প্রজাতিতে সঞ্চারিত হয়।
স্টার্ন ভয়ের অনেক উদাহরণ দিয়াছেন; তাহার মধ্যে ছাতা খুলিলে ভয় পাওয়া এবং কলের পুতুল দেখিয়া ভয় পাওয়ার কথাও আছে। প্রথমোক্তটি গরু ঘোড়ার মধ্যেই বেশি; আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি গরু বা ঘোড়ার দলকে একটি ছাতার সাহায্যে ঊধ্বশ্বাসে ধাবিত করা যায়। স্টার্ন যেমন বর্ননা করিয়াছেন আমার নিজের ছেলের ভয়ও তেমনি ছিল। অস্পষ্ট দ্রুত চলমান ছায়া দেখিলে (যেমন রাস্তায় চলমান গাড়ির ছায়া যদি ঘরের দেওয়ালে পড়িত) ভয় পাইত। আমি মেঝেতে এবং দেওয়ালে আঙুল দিয়া ছায়া ফেলিতাম এবং তাহাকে দিয়া অনুরূপ করাইতাম; এইভাবে তাহার ছায়া-ভীতি দূর হইয়াছিল। শীঘই সে বুঝিয়াছিল ছায়া জিনিসটি কি এবং ইহাতে সে আনন্দ অনুভব করিত। কলের পুতুল সম্বন্ধেও এই নীতিই প্রযোজ্য। পুতুলের ভিতরকার কলকবজাটুকু দেখা হইলে সে আর ভয় পাইত না। কলকজা যদি দেখা না যাইত তবে ভয় দূর হইতে কিছু সময় লাগিত। কেহ তাহাকে একটি ছোট বসিবার আসন দিয়াছিল; চাপ দিলেই ইহা হইতে এক রকম করুণ একটানা শব্দ বাহির হইত। অনেকদিন পর্যন্ত সে এটা দেখিয়া ভয় পাইয়াছে। কিন্তু আমরা এই ভয়ের জিনিসটাকে কিছুতেই সরাইয়া ফেলি নাই। প্রথমে এটি কিছুটা দূরে রাখা হইয়াছিল যাহাতে সে বেশি ভয় না পায়। পরে অল্প অল্প করিয়া এটি ছেলের কাছে পরিচিত করাইয়া লইলাম এবং তাহার ভয় সম্পূর্ণ দূর না হওয়া পর্যন্ত থামি নাই। আসনের যে রহস্যময় ভাবের জন্য এটি ভীতিপ্রদ হইয়াছিল। খোকার ভয় কাটিয়া যাওয়ার পর ইহাই তাহাদের আনন্দ দিয়াছে। আমার মনে হয় অবাস্তব ভয় চাপিয়া রাখা ঠিক উচিত নয়; ক্রমে ক্রমে পরিচয় জন্মাইয়া ইহা সম্পূর্ণ দূর করাই সঙ্গত।