আসল কথা হইল শিশুর মধ্যে ভবিষ্যতের একজন বয়স্ক ব্যক্তির সম্ভাবনা নিহিত রহিয়াছে ইহা মনে করিয়া ছোট্ট শিশুর প্রতিও শ্রদ্ধাযুক্ত আচরণ করুন। আপনার বর্তমান সুবিধার নিকট কিংবা শিশুকে অত্যধিক আদর করিয়া যে আনন্দ পান তাহার নিকট শিশুর ভবিষ্যৎ বলি দিবেন না। এই দুইটিই সমান ক্ষতিকর। অন্যত্র যেমন এখানেও তেমনই শিশুর শিক্ষাদান ব্যাপারে ঠিক পথে চলিতে হইলে স্নেহ ও জ্ঞানের মিলন আবশ্যক।
০৪. ভয়
পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে দুই হইতে ছয় বৎসর বয়স্ক শিশুর নৈতিক শিক্ষার বিষয় আলোচনা করিব। শিশুর বয়স ছয় বৎসর হইতেই তাহার নৈতিক শিক্ষা প্রায় শেষ হওয়া উচিত; অর্থাৎ পরবর্তীকালে বালক-বালিকার নিকট হইতে যে গুণের বিকাশ আশা করা হইবে এই সময়ের মধ্যে ভালো অভ্যাস গঠনের ফলে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগরিত হওয়ায় তাহার সূত্রপাত হওয়া চাই। যেখানে নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয় কিংবা খারাপভাবে দেওয়া হয় কেবল সেখানেই পরে এ শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক হইয়া পড়ে।
ধরিয়া লইলাম যে, পূর্ব অধ্যায়ে চারিত্রিক শৃঙ্খরা বিধানের জন্য যে প্রণালী আলোচিত হইয়াছে তাহা অবলম্বিত হওয়ায় শিশু সুখি ও স্বাস্থ্যবান হইয়া এক বৎসর বয়সের হইয়াছে। অবশ্য পিতামাতার সর্বপ্রকার যত্ন সত্ত্বেও অল্পসংখ্যক শিশুর স্বাস্থ্য খারাপ থাকিবেই। কিন্তু আশা করা যায় যে, কালক্রমে এ সংখ্যাও হ্রাস পাইবে। বর্তমান যুগের জ্ঞান যথাযথভাবে প্রয়োগ করিলে অন্য দিক দিয়া রুগ্ন শিশুর সংখ্যা খুবই তুচ্ছ হইত। যে সব শিশুর শৈশবের শিক্ষা ভালো হয় নাই তাহাদের জন্য কি করা উচিত তাহা আমার আলোচ্য বিষয় নয়; এ সমস্যা শিক্ষকের, পিতামাতার নয়। এ-বই বিশেষ করিয়া সন্তানের পিতামাতার উদ্দেশ্যেই লিখিত।
শিশুর দ্বিতীয় বৎসর খুবই আনন্দময়। সে হাঁটিতে এবং কথা বলিতে শিখিয়াছে; ইহার ভিতর সে স্বাধীনতা ও নূতন শক্তির সন্ধান পাইয়াছে। শিশু দিন দিন বাড়িতে থাকে। (১) তাহার পক্ষে স্বাধীনভাবে খেলা করা সম্ভব হয়, এবং বিশ্বের সব জিনিস দেখিবার বাসনা তাহার এত বেশি হয় যে, একজন ভূপর্যটকের তত হয় না। পাখি, ফুল, নদী, সমুদ্র, মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, স্টিমার প্রভৃতি তাহার অপরিসীম আনন্দ ও কৌতূহলের উদ্রেক করে। এই সময় তাহার কৌতূহলের শেষ নাই, প্রায়ই তাহার মুখে শোনা যাইবে দেখতে চাই। নিজের শোওয়ার খাট কিংবা ঠেলাগাড়ি হইতে মুক্ত হইয়া শিশু বাগানের ভিতর, মাঠে অথবা সাগরতীরে ছোটাছুটি করিয়া মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে। প্রথম বৎসর অপেক্ষা এখন হজম শক্তি বেশি হইয়াছে, খাদ্যেও বৈচিত্র্য আসিয়াছে; চিবানো এখন একটি নূতন আনন্দ। এইসব কারণে শিশুর যদি উপযুক্ত যত্ন লওয়া হয় এবং যদি তাহার স্বাস্থ্য ভালো থাকে তবে এই বয়সে শিশুর জীবন তাহার কাছে আনন্দময় এবং রোমাঞ্চকর মনে হয়।
হাঁটা ও দৌড়ানোর মধ্যে শিশু যে নূতন স্বাধীনতার সন্ধান পায় তাহার সঙ্গে একটি নূতন ভয়ও তাহার মনে আসে। শিশুকে সহজেই ভয় দেখানো যায়; ডক্টর এবং শ্রীমতী ওয়াটসন দেখিয়াছেন যে, শিশু উচ্চ শব্দ এবং পড়িয়া যাওয়ার আশঙ্কা হইতে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। শিশুকে এমনভাবে যত্নের সঙ্গে রাখা হয় যে, ইহার বাস্তব ভয়ের কোনো কারণই থাকিতে পারে না; সত্যিকারের কোনো বিপদ হইলেও শিশু সেখানে অসহায়, কাজেই ভয় শিশুর কোনো কাজেই আসিবে na। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৎসরে শিশুর মনে নূতন ভয় আসে। তর্কের বিষয় হইল এই যে, এই ভয় কি শিশুর প্রবৃত্তিগত অর্থাৎ আপনা-আপনি বিকশিত হয়, না অন্যের নিকট হইতে শিশু ইহা ছোঁয়াচে রোগের মতো পায়? শিশুর প্রথম বৎসরে ভয় থাকে না, কিন্তু তাই বলিয়া ইহা যে প্রবৃত্তি হইতে জ্ঞাত নয় এমন প্রমাণ করা চলে না; কেননা যে-কোনো বয়সে একটি প্রবৃত্তি পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে। উগ্র ফ্রয়েডবাদীও বলিবেন না যে, জন্মের সময়ই শিশুর যৌন প্রবৃত্তি পরিপূর্ণ মাত্রায় রহিয়াছে। স্পষ্টতই দেখা যায় যে শিশু হাঁটিতে পারে না তাহার চেয়ে যে চলাফেরা করিতে পারে তাহারই ভয়ের প্রয়োজন বেশি; কাজেই যখন প্রয়োজন তখন যদি ভয় প্রকাশ পাইতে থাকে তবে বিস্ময়ের কিছু নাই। এ প্রশ্নটির শিক্ষাসম্বন্ধীয় গুরুত্ব অনেক। ভয় যদি অন্যের নিকট হইতে সংক্রামিত হয় তবে সহজ উপায়েই ইহা নিবারণ করা যায়–যেমন শিশুর সম্মুখে ভয় বা বিরক্তি প্রকাশ না করিয়া পক্ষান্তরে যদি কতক ভয় প্রবৃত্তি হইতে উদ্ভূত হয় তবে ইহা নিবারণের জন্য আরও ব্যাপক কোনো পন্থা গ্রহণ করিতে হইবে।
ডক্টর চার্মাস মিচেল তাহার The Childhood of Animals (জীবজন্তুর শৈশব) পুস্তকে পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করিয়াছেন যে, সাধারণত জীবজন্তুর শাবকদের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভয় থাকে না। বানর এবং কয়েক প্রকার পাখি ছাড়া অন্য কোনো জীবের শাবক তাহাদের প্রজাতির চিরশত্রু। যেমন সাপ প্রভৃতিকেও মোটেই ভয় করে না, যদি না তাহাদের জনক-জননী তাহাদিগকে ভয় করিতে শিখাইয়া না দেয়। এক বছরের কম বয়সের শিশু কোনো প্রাণীকেই ভয় করে না। এইরূপ একটি শিশুকে ডক্টর ওয়াটসন ইঁদুরকে ভয় করিতে শিখাইয়াছিলেন; যখনই ইঁদুরটি ইহার সামনে আসিত তখনই শিশুটির পিছনে খুব জোরে ঘণ্টার আওয়াজ করিতেন; আওয়াজ শুনিয়া সে ভয় পাইত; ক্রমে ইঁদুরের সঙ্গে এই ভয়েই সংযোগ সাধিত হইল অর্থাৎ পরে শব্দ না হইলেও ইঁদুর দেখিলেই সে ভীত হইত। কিন্তু প্রাণী শাবকদের প্রথম কয়েক মাসে কোনো প্রবৃত্তি-জাত ভয় থাকে না। অন্ধকারে ভয়ের কারণ আছে বলিয়া যাহাদিগকে শিখানো হয় নাই এমন ছেলেমেয়েদের অন্ধকার ভীতিপ্রদ নয়। এরূপ ধারণার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বেশিরভাগ ভয় যাহা আমরা এতদিন প্রবৃত্তিজাত মনে করিতাম অপরের নিকট হইতে সঞ্চারিত হয়; বয়স্ক ব্যক্তিরা সৃষ্টি না করিলে এরূপ ভয় মোটেই দেখা দিত না।