শিশু কেবল খাইবার সময়ই আনন্দ পায়। তাহা ছাড়া শিশুর প্রথম তিন মাস মোটের উপর বড়ই নিরানন্দময়। আরাম বোধ করিলেই সে ঘুমাইবে। জাগিলেই কিছুটা অস্বস্তি। মনের শক্তির উপর মানুষের সুখ নির্ভর করে কিন্তু তিনি মাসের কম বয়সের শিশুর মধ্যে ইহা দেখা দেয় না; তখন তাহার অভিজ্ঞতা হয় নাই, পেশিও ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে না। ইতর প্রাণীর বাচ্চাগুলি অল্প বয়স হইতেই জীবন উপভোগ করিতে শুরু করে কারণ তাহাদের অধিকাংশ আচরণই প্রকৃতি কর্তৃক চালিত; অভিজ্ঞতার বিশেষ প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মানবশিশু প্রবৃত্তিচালিত হইয়া আনন্দদায়ক কাজ খুব কমই করিতে পারে। মোটের উপর শিশুর প্রথম তিন মাস কালকে অবসাদের কাল বলা যায়; কিন্তু অধিক সময় ঘুমাইবার জন্য এরূপ অবসাদেরই প্রয়োজন। শিশুকে বেশি আমোদ আহ্লাদ দিতে গেলে তাহার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিবারই সম্ভাবনা।
শিশুর বয়স যখন দুই তিন মাস তখন সে হাসিতে শেখে এবং মানুষ ও জড়পদার্থের মধ্যে পার্থক্য বুঝিতে পারে। এই সময় হইতে মায়ের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিতে থাকে; মাকে দেখিলে সে আনন্দ প্রকাশ করে এবং সাড়া দেয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাহার মনে প্রশংসা ও অনুমোদন পাওয়ার বাসনা জাগিয়া ওঠে। আমার নিজের ছেলের বয়স যখন পাঁচ মাস তখন এ বাসনায় স্পষ্ট প্রকাশ দেখা গিয়াছে, কয়েকবার চেষ্টার পর সে টেবিলের উপর হইতে একটা ভারী ঘণ্টা তুলিয়া লইল এবং বাজাইবার সময়ে গর্বের হাসি হাসিয়া সকলের মুখের দিকে তাকাইতে লাগিল। এই সময় হইতে শিক্ষকের হাতে একটি নূতন অস্ত্র আসিল ইহা হইল প্রশংসা ও নিন্দা। শৈশবে এই অস্ত্রের শক্তি খুব বেশি কিন্তু বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে ইহা প্রয়োগ করিতে হইবে। শিশুর প্রথম বছরে তাহাকে কখনই নিন্দা করা ঠিক হইবে না, পরেও ইহা খুব কম প্রয়োগ করিতে হইবে। প্রশংসা বরং কম ক্ষতিকর। কিন্তু ইহা অতি অল্পতেই যখন তখন প্রয়োগ করিলে ইহার মূল্য কমিয়া যায়; শিশুকে অতিরিক্ত মাত্রায় উৎসাহিত করার জন্যও ইহা প্রয়োগ করা উচিত নয়। শিশু যখন প্রথম হাঁটে এবং বোধগম্য কথা বলে তখন খুব কম পিতামাতাই প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারেন। তাহা ছাড়া শিশু যখন চেষ্টা করিয়া কোনো কঠিন বিষয়ে কৃতকার্য হয় তখন পুরস্কার হিসাবে প্রশংসা তাহার সত্যই প্রাপ্য। অধিকন্তু শিশুকে ইহা বুঝিতে দেওয়া ভালো যে, আপনি তাহার শিক্ষার বাসনার সহানুভূতি দেখাইতেছেন।
শিশুর শিখিবার বাসনা এত বেশি যে, পিতামাতা কেবল ইহার সুযোগ করিয়া দিলেই যথেষ্ট। শিশুকে আত্মবিকাশের সুযোগ দিন, সে নিজের চেষ্টাতেই অগ্রসর হইবে। শিশুকে হামাগুড়ি দিতে, হাঁটিতে অথবা তাহার পেশি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অন্য কোনো কিছু শিখাইতে হইবে না। আমরা অবশ্য কথা বলানো শিখাইব কিন্তু ইহাতে কোনো উপকার হয় কি না সন্দেহ। শিশুরা নিজেদের বুদ্ধির সঙ্গে সমতা রাখিয়া শিখিতে থাকে, জোর করিয়া শিখানোর চেষ্টা করা ভুল। চেষ্টা করিয়া প্রাথমিক অসুবিধাগুলি জয় করিয়া কৃতকার্য হওয়ার যে অভিজ্ঞতা তাহাই সারাজীবন ধরিয়া চেষ্টার প্রেরণা জোগায়। এই অসুবিধাগুলি এমন হওয়া উচিত নয় যাহা শিশু জয় করিতে না পারিয়া নিরুৎসাহ হইয়া পড়ে কিংবা এমন সহজও হওয়া উচিত নয় যাহাতে কোনো চেষ্টারই প্রয়োজন হয় না। জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত ইহাই হইল মৌলিক নীতি। আমরা নিজেরা যাহা কিছু করি কেবল তাহা দ্বারাই শিখিয়া থাকে। বয়স্ক ব্যক্তি এইটুকু করিতে পারেন–শিশু যাহা করিতে চাহিবে এমন কিছু নিজে করিয়া দেখাইলেন যেমন ঝুমঝুমি বাজানো; তারপর কেমন করিয়া ঝুমঝুমি বাজাইতে হয় শিশু নিজে চেষ্টা করিয়া শিখুক। অন্যে যাহা করে তাহা দেখিয়া সে সেইরূপ চেষ্টা করিতে উৎসাহী হয় মাত্র; অন্যের কিছু করা তাই শিশুর শিক্ষা নয়, শিক্ষার প্রেরণা মাত্র।
নিয়মানুবর্তিতা এবং রুটিন মতো কাজ শিশুর জীবনে বিশেষ করিয়া প্রথম বৎসরে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রথম হইতে ঘুম, খাওয়া এবং মলমূত্র ত্যাগে নির্দিষ্ট অভ্যাস গঠন করাইতে হইবে। ইহা ছাড়া পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত শিশুর মনের দিক দিয়া বিশেষ উপকারী। ইহা তাহাকে জিনিস চিনিতে সাহায্য করে এবং তাহার মনে নিরাপত্তার ভাব গড়িয়া তোলে। আমার অনেক সময় মনে হইয়াছে যে, প্রকৃতির নিয়ম সর্বদা একইরকম থাকে বলিয়া যে বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস আমাদের মধ্যে গড়িয়া উঠিয়াছে নিরাপত্তার বাসনা হইতেই তাহার উৎপত্তি। যাহা ঘটিবে বলিয়া জানা আছে তাহার সঙ্গে আমরা আঁটিয়া উঠিতে পারি কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যদি অকস্মাৎ পরিবর্তিত হইয়া যাইত তবে আমরা বাঁচিতাম না। প্রথম অবস্থায় শিশু থাকে দুর্বল, তাহাকে আশ্বস্ত করিবার এবং সকল আপদ হইতে রক্ষা করিয়া আরামে রাখিবার প্রয়োজন আছে। শৈশবাবস্থার শেষ দিকে শিশুর নূতনের প্রতি ঝোঁক বাড়ে কিন্তু প্রথম বছরে অস্বাভাবিক জিনিস মাত্রই তাহার ভীতি উৎপাদন করে। যদি পারেন, শিশুকে ভয় অনুভব করিতে দিবেন না। যদি সে অসুস্থ হয় এবং আপনি উদ্বিগ্ন হন, আপনার উদ্বেগ সযত্নে গোপন রাখিবেন যাহাতে শিশু মোটেই বুঝিতে না পারে। এমন কিছুই করিবেন না যাহা উত্তেজনা সৃষ্টি করিতে পারে। শিশু যদি না খায়, না ঘুমায়, কিছুক্ষণ মলমূত্র ত্যাগ না করে তবে উদ্বেগের ভাব দেখাইবেন না। কেননা এরূপ করিলে শিশুর মনে আত্মপ্রাধান্যের ভাব উঠিতে পারে। ইহা কেবল শিশুর প্রথম বছরেই প্রযোজ্য নয়, পরেও মানিয়া চলা উচিত। শিশুকে কখনোই বুঝিতে দিবেন না যে, আপনি চান শিশু কোনো একটি স্বাভাবিক কাজ করুক যাহা তাহার নিজের পক্ষেও আনন্দদায়ক। যেমন খাওয়া এবং তাহা করিয়া সে আপনাকে আনন্দ দিক। এরূপ করিলে সে বুঝিবে যে একটি নূতন ক্ষমতা সে হাতে পাইয়াছে; এবং যাহা সে আপনা-আপনিই করিত তাহা করাইবার জন্য তাহাকে অন্যে আদর আপ্যায়ন তোষামোদ করুক ইহাই সে মনে মনে কামনা করিবে। অনুমান করিবেন না যে, শিশুর এইরূপ আচরণ বুঝিবার মতো বুদ্ধি নাই। ইহার ক্ষমতা কম, বুদ্ধিও সীমাবদ্ধ কিন্তু যেখানে সে ইহা প্রয়োগ করিতে পারে সেখানে তাহার বুদ্ধি বয়স্ক ব্যক্তির মতোই। প্রথম বারো মাসের মধ্যে শিশু যতখানি শেখে পরবর্তীকালে ওই পরিমাণ সময়ের মধ্যে সে আর ততখানি শিখিতে পারে না; অত্যন্ত সক্রিয় বুদ্ধি না থাকিলে কখনই ইহা সম্ভব হইত না।