পূর্বে বলা হইয়াছে সদ্যপ্রসূত শিশুর কোনো অভ্যাস থাকে না, থাকে কেবল কতকগুলি প্রতিবর্তী এবং প্রবৃত্তি। ইহা অনুমান করা যায় যে, তাহার জগৎ কোনোরূপ বস্তু দ্বারা গঠিত নয়। কোনো জিনিস চিনিতে হইলে বারংবার একই প্রকার অভিজ্ঞতা দরকার; কোনো জিনিস সম্বন্ধে ধারণা জন্মিবার পূর্বে তাহা নিশ্চয়ই চিনিতে হইবে। শিশুর কাছে তাহার খাটের স্পর্শ, তাহার মায়ের স্তন বা দুধের বোতলের গন্ধ ও স্পর্শ এবং তাহার মায়ের কিংবা ধাত্রীর কণ্ঠস্বর অল্প সময়ের মধ্যে পরিচিত হইয়া ওঠে। তাহার মায়ের চেহারা বা খাটের আকৃতি সম্বন্ধে ধারণা পরে আসে, কেননা সদ্যোজাত শিশু কোনো জিনিস ভালো করিয়া দেখিবার মতো চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে পারে না, ক্রমে সংস্পর্শের ফলে অভ্যাস গঠনের ভিতর দিয়া স্পর্শ, দৃষ্টি, ঘ্রাণ এবং শ্রবণ একত্রে মিলিয়া কোনো বিষয় সম্বন্ধে শিশুর ধারণা জন্মায় অর্থাৎ স্পর্শ করিয়া, চোখ দিয়া দেখিয়া ঘ্রাণ লইয়া এবং শব্দ শুনিয়া শিশু কোনো বস্তু সম্বন্ধে ধারণা গঠন করে; একটি চিনিলে আর একটি চিনিতে আগ্রহ জন্মে। তখনও কিছু সময়ের জন্য শিশুর কোনো পদার্থ বা মানুষের মধ্যে পার্থক্য বোধ জন্মে না। যে শিশু কখনও মায়ের দুধ পান করে, কখনও বা বোতলভরা দুধ পান করে সে কিছুদিন পর্যন্ত তাহার মা এবং বোতলের প্রতি একইরকম ভাব পোষণ করিবে। এই সময়ে কেবল নিছক দৈহিক উপায়েই শিক্ষা দিতে হইবে। এ সময়ে শিশুর আনন্দ এবং কষ্ট সবই দৈহিক। খাবার পাইলে এবং কোমল উষ্ণতা বোধ করিলে সে আনন্দিত হয়, দেহের ব্যথাতেই কষ্ট পায়। আনন্দের সহিত যাহা সংযুক্ত তাহা পাওয়ার জন্য আচরণের অভ্যাস এবং কষ্টের সঙ্গে যাহা সংযুক্ত তাহা পরিহার করার জন্য আচরণের অভ্যাস এই সময় গড়িয়া ওঠে। শিশুর ক্রন্দন আংশিকভাবে প্রতিবর্তী মাত্র, দৈহিক কষ্ট পাইলেই স্বভাবতই সে কাঁদিয়া ওঠে; আনন্দ পাওয়ার উপায় হিসাবেও কখনও কখনও শিশু কাঁদিয়া থাকে। প্রথম প্রথম অবশ্য কেবল কষ্ট অনুভব করিয়াই কাঁদে। শিশু যখন কষ্ট বা ব্যথা পাইয়া কাঁদিতে থাকে তখন কষ্টের কারণ দূর করিলেই সে আনন্দ পায়। এইভাবে কাদার সঙ্গে আনন্দের অনুভূতির যোগ সাধিত হয়। ইহার পরে শিশু দৈহিক কোনোরকম ব্যথা বোধ না করিলেও আনন্দ কামনা করিয়া কাঁদিতে শুরু করে; ইহা তাহার বুদ্ধির জয়ের একটি প্রথম পরিচয়। কিন্তু যতই চেষ্টা করুক, প্রকৃত বেদনা বা কষ্ট বোধ করিলে যেভাবে চিৎকার দেয় সেরূপ চিৎকার কিন্তু তাহার মুখ দিয়া বাহির হয় না। মায়ের কানে এ পার্থক্য ধরা পড়ে এবং তিনি যদি বুদ্ধিমতি হন তবে যে কান্না দৈহিক কষ্টের দ্যোতক নয় তাহা উপেক্ষাই করিবেন। শিশুকে কোলে করিয়া নাচাইয়া কিংবা ইহার কানের কাছে মিষ্টি স্বরে গান করিয়া আনন্দ দেওয়া সহজ এবং শিশুর কাছে তাহা আরামদায়ক। এরূপ পাইলে শিশু শীঘ্রই আরও বেশি বেশি আরাম দাবি করিবে এবং ইহা না হইলে ঘুমাইবে না; কিন্তু কেবল খাবার সময় ছাড়া সারা দিন শিশুর ঘুমাইয়া কাটানো উচিত। এ উপদেশ কঠোর মনে হইতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতা হইতে দেখা যায় যে, ইহা শিশুর স্বাস্থ্য ও আনন্দের কারণই হইয়া থাকে।
বয়স্ক ব্যক্তিরা শিশুদিগকে আদর দিতে গিয়া যেন বাড়াবাড়ি না করে সেদিকে লক্ষ রাখিতে হইবে; শিশুরা নিজেদেরই চেষ্টায় যে আনন্দ লাভ করিতে পারে তাহাতে বরং উৎসাহ দিতে হইবে। প্রথম হইতেই যাহাতে ইহারা হাত-পা ছুড়িয়া মাংসপেশির সঞ্চালন করিতে পারে তাহার সুবিধা করিয়া দিতে হইবে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এতদিন পর্যন্ত কেমন করিয়া শিশুদিগকে গরম কাপড় দিয়া জড়াইয়া রাখিতেন ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। ইহা দেখিয়া মনে হয় সন্তান-স্নেহ আলস্যকে জয় করিতে পারে নাই, কেননা হাত-পা মুক্ত থাকিলে শিশুর প্রতি বেশি সতর্কতা রাখিতে হয়। যখন শিশু দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে পারে তখন হইতেই সে চলমান জিনিস দেখিতে আনন্দ পায়, বিশেষ করিয়া হাওয়ায় কোনো কিছু দুলিতে দেখিলে। কিন্তু যতদিন না শিশু যাহা দেখে তাহা ধরিতে পারে ততদিন ইহার আনন্দদানের জিনিস খুব বেশি থাকে না। তারপর অকস্মাৎ একটি নূতন আনন্দের সন্ধান পায়–ইহা হইল কোনো জিনিস ধরিবার আনন্দ। কিছুদিন শিশু জাগ্রত অবস্থায় অনেকটা সময় কিছু ধরিয়া বা ধরিবার চেষ্টা করার আনন্দে অতিবাহিত করে। এই সময় সে ঝুমঝুমি হইতে আনন্দ পায়। ইহার কিছু আগে সে হাত-পায়ের আঙুল জয় করিয়াছে। প্রথমে শিশু পায়ের আঙুলগুলির যে সঞ্চালন তাহা সম্পূর্ণ প্রতিবর্তী, অর্থাৎ শিশু নিজে ইচ্ছা করিয়া চালায় না, আপনা আপনি সঞ্চালিত হয়; পরে সে বুঝিতে পারে যে, ইহার সঞ্চালন তাহার আয়ত্তে। একজন সাম্রাজ্যবাদী কোনো বিদেশ জয় করিলে যেরূপ আনন্দিত হন, হাত পায়ের উপর অধিকার লাভ করিয়া শিশুও সেইরূপ আনন্দ অনুভব করে। এগুলি তখন তাহার কাছে আর বাহিরের অঙ্গ নয়। তাহার নিজের অধিকারে; নিজ দেহেরই অংশ। শিশুর পক্ষে উপযুক্ত জিনিস তাহার হাতের কাছে থাকিলে এই সময় হইতে সে অনেক প্রকারে আনন্দ লাভ করিতে পারে। এই ধরনের আনন্দ শিশু শিক্ষার পক্ষে উপযোগী, অবশ্য দেখিতে হইবে সে যেন উলটাইয়া না পড়ে, পিন গিলিয়া না ফেলে কিংবা অন্য প্রকারে আঘাত না পায়।