শৈশবে অভ্যাস গঠনের বিষয় আলোচনা করিবার সময় দুইটি বিষয়ের কথা ওঠে : প্রথম এবং বিশেষ প্রয়োজনীয় হইল স্বাস্থ্য, দ্বিতীয় চরিত্র। আমরা চাই শিশু যেন সকলের প্রিয় হয় এবং জীবন-সংগ্রামে জয়ী হইতে সমর্থ হয়। সৌভাগ্যক্রমে স্বাস্থ্য এবং চরিত্র এ উভয়েরই লক্ষ্য ইহাই; একটির পক্ষে যাহা শুভঙ্কর অন্যটির পক্ষেও তাহা কল্যাণকর। এই পুস্তকে আমরা চরিত্র সম্বন্ধেই বিশেষভাবে বিবেচনা করিব; কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্যও অনুরূপ অভ্যাস এবং প্রক্রিয়া দরকার। কাজেই আমাদিগকে স্বাস্থ্যবান শয়তান বা রুগ্ন ঋষির মধ্যে একজনকে বাছিয়া লইবার কঠিন সমস্যার সম্মুখিন হইতে হইবে না।
শিশু যখন চিৎকার করে তখনই না খাওয়াইয়া নিয়মিত সময় অন্তর খাওয়ানোর উপকারিতা আজকাল প্রত্যেক মাতাই জানেন। এ রীতি প্রচলিত হইয়াছে এইজন্য যে, ইহা শিশুর হজম ক্রিয়ার পক্ষে উপকারী; এ কারণই নিয়মিত খাবার দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কিন্তু নৈতিক শিক্ষার পক্ষেও ইহা বাঞ্ছনীয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা যতখানি মনে করেন শিশুরা তাহার চেয়ে অনেক বেশি চতুর; যদি তাহারা দেখে যে, চিৎকার করিলেই আরামদায়ক কিছু পাওয়া যায় তবে তাহারা চিৎকার করিবেই। পরবর্তীকালে সবকিছু লইয়াই খুঁত খুঁত করার বা আবদার করার অভ্যাসের ফলে যখন তাহারা অপরের নিকট অপ্রিয় হয় এবং নিজেদের ঈপ্সিত জিনিস পায় না,তখন তাহারা রুষ্ট ও বিস্মিত হয়; জগৎ তাহাদের নিকট উদাসীন এবং সহানুভূতিহীন বলিয়া মনে হয়। তাহারা আদর পাইবে এবং ইহার ফলে শৈশবে যে কুশিক্ষা পাইয়াছিল তাহাই দৃঢ়তর হইবে। ধনীলোকের বেলাতেও ইহা সত্য। শৈশবে যদি উপযুক্ত শিক্ষা না পায় তবে পরবর্তীকালে তাহারা (নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী) মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়ায় হয় অসন্তুষ্ট হইবে, আর না হয় হইবে স্বার্থপর ও অত্যাচারী। যে মুহূর্তে শিশুর জন্ম হয় তখনই নৈতিক শিক্ষাদান আরম্ভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়; কেননা তখন তাহার কোনো বাসনা গঠিত হয় নাই; কাজেই তখন এ শিক্ষা দিতে গিয়া তাহার কোনো বাসনাকে খর্ব করিতেও হইবে না। পরবর্তীকালে এ শিক্ষা দিতে গেলেই কতকগুলি অভ্যাসের বিরুদ্ধে ইহা প্রয়োগ করিতে হইবে এবং স্বভাবতই ইহা শিশুর ক্রোধের উদ্রেক করে।
শিশুর সঙ্গে ব্যবহারে অবহেলা ও আদর এই দুইটির মধ্যে সমতা রাখা দরকার। তাহার স্বাস্থ্যের জন্য যাহা প্রয়োজন তাহা অবশ্যই করিতে হইবে; ঠাণ্ডা বাতাসে থাকিলে তাহাকে তুলিয়া শুকনা গরম জায়গায় রাখিতে হইবে। কিন্তু কাঁদিবার পক্ষে যথেষ্ট কোনো দৈহিক কারণ না থাকা সত্ত্বেও যদি সে কাঁদিতে থাকে, তাহাকে কাঁদিতেই দিতে হইবে; তাহা না হইলে অল্পদিনের মধ্যেই সে স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিবে। তাহাকে পরিচর্যা করিবার সময় অযথা হইচই বা অত্যধিক আদর ও প্রীতি দেখাইবার কোনো প্রয়োজন নাই। কোনো বয়সেই শিশুকে অতিরিক্ত মাত্রায় আদর আপ্যায়ন দেখানো উচিত নয়। প্রথম হইতেই তাহাকে একজন ভাবী বয়স্ক ব্যক্তিরূপে দেখিতে হইবে। বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে যে অভ্যাস অসহনীয় মনে হয়, শিশুর মধ্যেই তাহাই প্রীতিকর বোধ হইতে পারে। অবশ্য শিশু যথার্থ বয়স্ক ব্যক্তির অভ্যাস গঠন করিতে পারে না, তবে এরূপ অভ্যাস গঠনে যাহা যাহা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিতে পারে তাহা এড়াইয়া যাওয়াই উচিত। সর্বোপরি কখনই শিশুর মনে আত্ম-প্রাধান্যের ভাব জন্মিতে দেওয়া ঠিক হইবে না, কেননা এই ভাব গড়িয়া উঠিলে পরবর্তী বয়সে সে যখন অন্য সকলের নিকট হইতে বিশেষ আপ্যায়ন পাইবে না, তখন তাহার মনে আঘাত লাগিবে।
শিশুকে শিক্ষা দিবার সময় পিতামাতার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হইল আদর ও অনাদরের মধ্যে সূক্ষ্ম সমতা রাখিয়া আচরণ করা। শিশুর যাহাতে কোনো প্রকার স্বাস্থ্যহানি না ঘটে সেজন্য সদাজাগ্রত সতর্কতা এবং যত্ন দরকার। সন্তানের প্রতি মমতা অত্যধিক না হইলে এগুলি প্রায় দেখা যায় না। কিন্তু যেখানে এইরূপ সতর্কতা ও যত্ন পরিচর্যা আছে সেখানে হয়তো বিশেষ বিজ্ঞতার সঙ্গে এগুলি প্রয়োগ করা হয় না। স্নেহশীল পিতামাতার কাছে সন্তান একটি মহাসামগ্রী। পিতামাতা যদি সন্তানের প্রতি আচরণে বিশেষ সংযত না হন তবে শিশু ইহা বুঝিতে পারে এবং নিজেকে মহামূল্যবান মনে করিয়া নিজের সম্বন্ধে কাল্পনিক উচ্চ ধারণা গড়িয়া তোলে। পরবর্তীকালে সামাজিক পরিবেশে সে তো পিতামাতার কাছে যেরূপ পাইয়াছে সেরূপ আদর যত্ন পাইবে না; পিতামাতার অহেতুক স্নেহের আতিশয্য তাহার মনে যে ধারণা সৃষ্টি করিয়াছিল যে সে সকলের আদরের মধ্যমণি তাহা অবশেষে তাহাকে নিরাশ করিবে। কাজেই পিতামাতার কর্তব্য হইল শুধু শিশুর প্রথম বৎসর নয়, পরেও সন্তানের কোনো অসুখ ও বিসুখ হইলে উকণ্ঠা প্রকাশ না করিয়া স্বাভাবিকভাবে প্রফুল্লতার সঙ্গেই তাহা গ্রহণ করা উচিত। আগের দিনে শিশুর অসুখ হইলেই তাহাকে অন্য সকলের কাছ হইতে পৃথক করিয়া, জামাকাপড় দিয়া আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া বিছানায় শোওয়াইয়া রাখা হইত, কিংবা কোলে করিয়া অথবা দোলনায় রাখিয়া দোলানো হইত। তাহার স্বতঃস্ফূর্ত আচরণে বাধা পড়িত। সন্তান মানুষ করার এই পন্থা ছিল আগাগোড়া ভুলে ভরা। ইহা শিশুকে অসহায়, পরজীবী আদুরে গোপালে পরিণত করিত। যথার্থ নিয়ম হইল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত কাজে উৎসাহ দিন, কিন্তু অন্যের উপর দাবি করিলে তখন তাহাকে থামান। আপনি শিশুর জন্য কতখানি করেন বা কি পরিমাণ কষ্ট করেন তাহা শিশুকে দেখিতে দিবেন না। যেখানে সম্ভব সেখানে শিশু বয়স্ক ব্যক্তির উপর জুলুম করিয়া নয়, নিজের চেষ্টাতেই সাফল্য লাভ করুক; ইহাতে সে আত্মতৃপ্তি লাভ করিবে। আধুনিক শিক্ষায় আমাদের উদ্দেশ্য হইল–বাহিরের শাসন ও শৃঙ্খলা যথাসম্ভব কমাইয়া দেওয়া। ইহার জন্য ভিতর হইতে আত্মশৃঙ্খলা জাগানো দরকার। এই আত্মশৃঙখলা শিশুর প্রথম বছরে আয়ত্ত করানো যেমন সহজ তেমন কোনো সময়ে নয়। উদাহরণ দিয়া বলি শিশুকে যখন ঘুম পাড়াইতে চান তখন ইহাকে দোলনায় রাখিয়া দোলানো বা কোলে করিয়া বেড়াইবার দরকার নাই, এমনকি আপনি যেখানে থাকিলে সে শুইয়া থাকিয়া আপনাকে দেখিতে পাইবে এমন জায়গাতেও থাকিবেন না। কিন্তু আপনি যদি সোহাগ দেখাইয়া কোলে করিয়া ঘোরেন কিংবা আরামদায়ক দোল দেন, তবে পরে ঘুম পাড়াইতে চাহিলেও আপনাকে আবার ওইরূপ করিতে হইবে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে বুঝিবেন শিশুকে ঘুম পাড়ানো কি ঝকমারি কাজ। আপনি বরং উহাকে শুকনো জামা পরাইয়া, শুকনা বিছানায় শোওয়াইয়া দিন; তারপর শান্তস্বরে কয়েকটি মন্তব্য করিয়া চলিয়া আসুন। কয়েক মিনিট সে কাঁদিতে পারে কিন্তু যদি কোনোরূপ অসুখ না থাকে তবে সে খানিক পরেই থামিবে। তখন যদি দেখিতে যান, দেখিতে পাইবেন শিশু গভীর ঘুমে মগ্ন রহিয়াছে। কোলে করিয়া ঘোরা বা আদর করিয়া চাপড়ানোর চেয়ে এই প্রক্রিয়ায় শিশু অনেক বেশি ঘুমাইবে।