শিক্ষার ফলে যদি উদ্যম, সাহস, অনুভূতিশীলতা এবং বুদ্ধি নরনারীর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয় তবে এমন এক সমাজ গড়িয়া উঠিবে যেরূপ মানবগোষ্ঠী কোনোকালে ছিল না। খুব কম লোকই তখন অসুখি হইবে। বর্তমানে সুখি না হইবার প্রধান কারণ হইল : স্বাস্থ্যহীনতা, দারিদ্র্য এবং অসন্তোষজনক যৌনজীবন। এ সকলই তখন হইবে অত্যন্ত বিরল। প্রায় সকলেই তখন পূর্ণ স্বাস্থ্যের অধিকারী হইবে। এমনকি বার্ধক্যও বিলম্বের আসিবে। শিল্প-বিপ্লবের পর হইতেই দারিদ্রের একমাত্র কারণ হইয়াছে বহু লোকের সমবেত মূর্খতা। অনুভূতিশীল লোকের মধ্যে ইহা বিলোপ করার বাসনা জাগাইয়া তুলিবে, বুদ্ধি দেখাইবে কি উপায়ে ইহা সম্ভব এবং সাহস সে উপায় গ্রহণ করিতে উৎসাহিত করিবে। ভীরু ব্যক্তি অস্বাভাবিক কিছু করার পরিবর্তে বরং দুঃখদুর্দশার মধ্যেই থাকিতে পছন্দ করিবে। বর্তমানে অধিকাংশ লোকের যৌনজীবন কমবেশি রকমের অসন্তোষজনক। ইহার জন্য অংশত দায়ী কুশিক্ষা, অংশত দায়ী ভাব্যতার বাঁধাধরা সংস্কার এবং কর্তৃপক্ষের অত্যাচার। অবাস্তব যৌনভীতি হইতে মুক্ত এক প্রজাতি [Generation] স্ত্রীলোক এই অবস্থার অবসান ঘটাইবে। ভয় স্ত্রীলোকের পক্ষে গুণ বলিয়া ধরা হইয়াছে এবং চেষ্টা করিয়া তাহাদিগকে দেহে মনে ভীরু করিয়া গড়িয়া তোলা হইয়াছে। যে-সব স্ত্রীলোকের প্রেম স্বাভাবিকভাবে আত্মপ্রকাশের পথ পায় না, তাহারা তাহাদের স্বামীদের নিষ্ঠুরতা ও ভণ্ডামিতে উৎসাহ দেয় এবং তাহাদের সন্তান-সন্ততির প্রবৃত্তিগুলি বিকৃত করিয়া তোলে। একজনই নির্ভীক স্ত্রীলোক নির্ভীক, সরল, উদার স্নেহশীল এবং স্বাধীন সন্তানের জন্ম দিয়া বিশ্বের রূপই বদলাইয়া দিতে পারে। আমরা অলস, ভীরু, হৃদয়হীন এবং মূর্খ বলিয়া যে-সব নিষ্ঠুরতা এবং দুঃখ সহ্য করি, তাহাদের অন্তরের অনুরাগ ও উদ্যম সেগুলি নির্মূল করিয়া দূর করিয়া দিবে। শিক্ষা হইতে আমরা এই দোষগুলি পাই, আবার একমাত্র শিক্ষাই ইহার বিপরীত গুণগুলির বিকাশ ঘটাইতে পারে। শিক্ষাই নূতন জগতের চাবিকাঠি।
সাধারণ নীতির আলোচনা ছাড়িয়া দিয়া যে উপায়ে আমাদের আদর্শগুলি বাস্তব রূপ গ্রহণ করিতে পারে তাহার বস্তুনিষ্ঠ এবং বিস্তারিত আলোচনা আরম্ভ করা যাক।
০৩. চরিত্রের শিক্ষা
প্রথম বৎসর
পূর্বে শিশুর জীবনের প্রথম বসরকে শিক্ষার আওতার বাহিরে ধরা হইত। যতদিন শিশু কথা বলিতে না শেখে ততদিন ইহাকে জননীর বা ধাত্রীর সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে রাখা হইত; মনে করা হইত শিশুর পক্ষে কি মঙ্গলজনক তাহা হঁহারা নিজেদের প্রবৃত্তি হইতেই জানেন। প্রকৃতপক্ষে হাঁহারা কিছুই জানিতেন না। জীবনের প্রথম বৎসরেই বহু শিশু মারা যাইত; লালন-পালনের দোষে বহু খারাপ অভ্যাস গঠিত হইত। সম্প্রতি এ সকল বিষয় জানা গিয়াছে। শিশু-পালনাগারে যদি বিজ্ঞান প্রবেশ করে তবে অনেকে রুষ্ট হন। কেননা তাহাদের ধারণা শিশুর মঙ্গলের সম্পূর্ণ ভার মায়ের হাতে; শিশুর জীবনে মায়ের কথঞ্চিৎ স্থান যে বিজ্ঞান গ্রহণ করিবে তাহা তাঁহারা বরদাস্ত করিতে চান না। কিন্তু ভাবপ্রবণতা এবং বাৎসল্যপ্রীতি একসঙ্গে থাকিতে পারে না। যে জনক বা জননী নিজ সন্তানকে ভালোবাসেন তিনি চান যে তাঁহার সন্তান বাঁচিয়া থাকুক; দরকার হইলে এজন্য বুদ্ধি প্রয়োগ করিতেও তিনি কুণ্ঠিত নন; কাজেই নিঃসন্তান লোকের মধ্যে এবং রুশোর মতো যাহারা নিজেদের সন্তানদিগকে অনাথ আশ্রমে প্রতিপালনের পক্ষপাতি তাহাদের মধ্যেই এ ভাবপ্রবণতা প্রবল হইতে দেখা যায়। শিশুর পালন ব্যাপারে বিজ্ঞান কি বলে বেশিরভাগ শিক্ষিত জনক-জননী তাহা জানিতে ইচ্ছুক; অশিক্ষিত পিতামাতাও শিশুর-মঙ্গল কেন্দ্র হইতে ইহা জানিয়া লয়। ইহাতে যে সুফল ফলিয়াছে তাহা শিশু মৃত্যুর সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পাওয়া হইতে বোঝা যায়। ইহা বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, যথোপযুক্ত যত্ন ও নিপুণতা প্রয়োগ করিলে অতি অল্প শিশুই আঁতুড়ে মারা যাইবে। কেবল খুব অল্পই যে মরিবে তাহা নহে, যাহারা বাঁচিয়া থাকিবে তাহারা দেহে এবং মনে অধিকতর স্বাস্থ্যের অধিকারী হইবে।
শিশুর দৈহিক স্বাস্থ্যের প্রশ্ন (সমস্যা) এ পুস্তকের আলোচ্য নয়; ইহা চিকিৎসকদের হাতেই ছাড়িয়া দেওয়া উচিত। যেখানে ইহা মনোবিজ্ঞানের সহিত জড়িত সেখানেই কেবল ইহার উল্লেখ করিব। কিন্তু জীবনের প্রথম বছরে কোটি মানসিক, কোনটি দৈহিক সমস্যা তাহা নির্ণয় করা অসম্ভব। অধিকন্তু শিশুর দেহের দিকে কোনো লক্ষ্য না রাখিলে–কয়েক বৎসর পরে শিশুর দৈহিক সমস্যা শিক্ষকের প্রধান প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে। অতএব অনধিকার প্রবেশ হইলেও মধ্যে মধ্যে আমাদিগকে শিশুর দৈহিক প্রশ্ন লইয়াও আলোচনা করিতে হইবে।
সদ্যপ্রসূত শিশু কতকগুলি প্রতিবতী [reflx) স্বভাব এবং প্রবৃত্তি লইয়া ভূমিষ্ঠ হয়; প্রথমে ইহার অভ্যাস বলিয়া কিছু থাকে না। মাতৃগর্ভে থাকিবার সময় সে যাহা অভ্যাস করিয়াছিল তাহা নূতন পরিবেশে কোনোই কাজে আসে না। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াও অনেক সময় শিখাইতে হয় এবং কতক শিশু এই অভ্যাস তাড়াতাড়ি শিখিতে পারে না বলিয়াই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় একটি প্রবৃত্তি বেশ পুষ্ট [Developed] দেখা যায়; ইহা হইল চুষিবার প্রবৃত্তি। শিশু যখন কিছু চুষিতে শুরু করে তখন এই নূতন পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করে না। কিন্তু জাগ্রত অবস্থার অন্য সময়টুকু তাহার কাছে ফাঁকা, বিস্ময়কর মনে হয়। চব্বিশ ঘণ্টার অধিকাংশ সময় ঘুমাইয়া কাটাইয়া সে এই অস্বস্তিকর অবস্থায় আরামবোধ করে। এক পক্ষ পরে কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের মধ্যে নিয়মিতভাবে বারবার অভিজ্ঞতা লাভের পর কিছু পাওয়ার বাসনা তাহার মনে দানা বাঁধিযা উঠে। শিশু অত্যন্ত সংরক্ষণশীল; কোনো নূতনত্ব সে পছন্দ করে না। সে যদি কথা বলিতে পারিত, তবে হয়তো বলিত: তুমি কি মনে কর, আমার জীবনকালের অভ্যাস আমি ছাড়িয়া দিব? যেরূপ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শিশু অভ্যাস আয়ত্ত করে তাহা বিস্ময়কর। প্রত্যেকটি কু-অভ্যাস পরিবর্তীকালে সদভ্যাসগুলির প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায়; এ জন্যই অতি শৈশবে প্রথম অভ্যাস গঠনের গুরুত্ব এত বেশি। প্রথম অভ্যাসগুলি যদি ভালো হয় তবে পরে অশেষ ঝামেলার হাত হইতে রেহাই পাওয়া যায়। অধিকন্তু শৈশবে কোনো অভ্যাস আয়ত্ত হইলে তাহাকে পরে প্রবৃত্তি বলিয়া মনে হয় এবং প্রবৃত্তি মতোই ইহা স্থায়ী ও দৃঢ়মূল হইয়া উঠে। পরবর্তীকালে ইহার বিপরীত অভ্যাস গঠিত হইলে তাহা প্রথম গঠিত অভ্যাসের মতো দৃঢ় হয় না। এজন্যও প্রথম অভ্যাস গঠনের উপর খুবই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।