আমার নিজের মনে হয় সকলেরই অন্যকে খুশি করার ও অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করার বাসনা প্রবল এবং স্বাভাবিক কিন্তু এমন হওয়া চাই যেন কোনো বিশেষ জরুরি ক্ষেত্রে অন্য বাসনা দ্বারা ইহাকে জয় করা যায়। অনুভূতিশীলতা আলোচনার সময় আমরা অন্যকে খুশি করার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি। ইহা না থাকিতে দিলে আমরা সকলেই হইতাম অসভ্য, বর্বর এবং পরিবার হইতে উপরের দিকে কোনো সামাজিক দল গঠনই সম্ভবপর হইত না। শিশুরা যদি তাহাদের পিতামাতার প্রশংসা কামনা না করিত তবে তাহাদিগকে শিক্ষাদান করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হইত। প্রক্ষোভ যে একজন হইতে অন্য জনের মধ্যে সংক্রামিত হয় তাহারও উপকারিতা আছে, বিশেষ করিয়া ইহা যখন বিজ্ঞ লোক হইতে অজ্ঞ লোকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু ভয় বা রাগ যদি ব্যাপকভাবে বহু লোকের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তাহার ফল হয় ঠিক বিপরীত। কাজেই দেখা যায় প্রক্ষোভ সংক্রামণের অর্থাৎ এক ব্যক্তি হইতে অন্যের মধ্যে প্রক্ষোভ বা ভাব সঞ্চারের প্রশ্নটি কোনমতেই সহজ নয়। যেখানে শুধু বুদ্ধিগত ব্যাপার সেখানেও বিষয়টি সুস্পষ্ট নহে। বড় বড় আবিষ্কারকদিগকে তাঁহাদের মননশক্তি ও বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইয়াছিল। (উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কলম্বাসের কথা; স্থির বুদ্ধি ও দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে তিনি নূতন মহাদেশের সন্ধানে বাহির হইয়াছিলেন কিন্তু তাহার সঙ্গীদের নিজেদের বুদ্ধি ও আত্মবিশ্বাসের উপর বিশেষ আস্থা ছিল না। নিজেদের প্রাণের ভয়ে তাহারা কলম্বাসের অভিযানে বাধা সৃষ্টি করিতে উদ্যত হইয়াছিল।
সাধারণ মানুষ যদি অন্যের মতামত গ্রহণ না করিয়া সর্বদা কেবল নিজের অভিমতই প্রকাশ করিত তবে তাহার দরুন সে অজ্ঞতার পরিচয় দিত; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্তত তাহারা যে বৈজ্ঞানিকদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাহা কল্যাণকর হইয়াছে।
আমার মনে হয়, অতি অসাধারণ লোকের কথা বাদ দিলে সাধারণ মানুষের জীবনের দুইটি ক্ষেত্র আছে; একটি বড় ক্ষেত্র, সেখানে যূথপ্রবৃত্তি বা দলের সঙ্গে মিশিয়া, সহযোগিতা করিয়া দলের ভার গ্রহণ করিয়া চলিবার বাসনা প্রবল; অন্যটি ছোট ক্ষেত্র, যেখানে যূথপ্রবৃত্তি প্রবেশ করে না। এই ছোট ক্ষেত্রটি তাহার নিজের বিচারবুদ্ধির স্থান। যে ব্যক্তি আর অন্যান্য সকলে প্রশংসা না করা পর্যন্ত কোনো স্ত্রীলোককে প্রশংসা করিতে পারে না তাহার ব্যক্তিগত অভিমত সম্বন্ধে কেহই উচ্চ ধারণা পোষণ করে না। আমরা মনে করি পত্নী নির্বাচনের ব্যাপারে যে-কোনো লোকের পক্ষে সমাজের আর সকলে কি বলিবে সে চিন্তা না করিয়া নিজের স্বাধীন অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা চালিত হওয়া উচিত। তাহার প্রতিবেশিদের অভিমতের সঙ্গে তাহার মতের মিল হইবে কি না সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়; সে যদি কোনো মেয়েকে ভালোবাসে তবে তাহার পক্ষে নিজের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও ভালোবাসার অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হওয়াই উচিত।
ইহার বিপরীত দিকেও অনুরূপ কথা বলা চলে। চাষি যে জমি চাষ করে তাহার গুণাগুণ ও উৎপাদন ক্ষমতা সম্বন্ধে সে নিজের অভিমত অনুযায়ী কাজ করিবে যদিও চাষ-আবাদের বৈজ্ঞানিক প্রণালী সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়ার পরেই সে নিজের অভিমত গঠন করিতে পারিবে। অর্থনীতিক প্রচলিত মুদ্রা সংক্রান্ত প্রশ্নে নিজের স্বাধীন অভিমত গঠন করিবেন, কিন্তু সাধারণ লোকের পক্ষে ওইরূপ জটিল ব্যাপারের মধ্যে মাথা না ঘামাইয়া বিশেষজ্ঞের অভিমত মানিয়া চলাই কর্তব্য। যেখানেই বিশেষজ্ঞান, গবেষণা ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োজিত হয় সেখানেই অভিমতের স্বাধীনতা মানিয়া চলা উচিত। কিন্তু তাই বলিয়া বিশেষজ্ঞগণ অত্যুগ্র মতের কন্টকে নিজেদের আবৃত রাখিযা জনসাধারণকে দূরে সরাইয়া রাখিলে বিশেষ কোনো উপায় হইবে না। আমাদের বেশিরভাগ কাজই সহযোগিতামূলক হওয়া উচিত এবং প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করিয়াই সহযোগিতা গড়িয়া তোলা। কর্তব্য। তবু যে-সব বিষয় আমাদের ভালো রকম আছে সে সম্বন্ধে নিজেদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করিবার ক্ষমতা থাকা চাই এবং প্রয়োজন হইলে অন্যের পক্ষে। অপ্রিয় হইলেও স্বাধীন অভিমত প্রকাশ করিবার সৎসাহস থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এই সাধারণ নীতি প্রয়োগ করিতে হয়তো অসুবিধা হইতে পারে। কিন্তু আমরা যে-সব গুণের কথা আলোচনা করিতেছি তাহা যখন বেশিরভাগ লোকের মধ্যে দেখা যাইবে তখন ইহা প্রয়োগ করিতে এত বেশি কঠিন হইবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, এই রকম জগতে সাধু ব্যক্তির উপর অত্যাচার চলিবে না; প্রকৃত সৎলোকে আত্মাভিমানে গর্বিত হইয়া বিশ্বজন হইতে পৃথক থাকিবেন না; ভাবের আবেগ দ্বারা চালিত সৎস্বভাব সুখের কারণ হইয়া উঠিবে। তাঁহার প্রতিবেশিরা তাঁহাকে ঘৃণা করিবে না কারণ তাহারা তাহাকে ভয় করিবে না। অগ্রগামী ব্যক্তিগণ [Pioneers] অপরের ভয় উৎপাদন করেন বলিয়াই তাহাদের ঘৃণার পাত্র হইয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা সাহসী হইতে শিখিয়াছে তাহাদের মধ্যে এরূপ ভয় থাকিবে না। ভয়ে অভিভূত হইয়া লোকে কু ক্লাক্স ক্লান [Ku Klux Klan] কিংবা ফ্যাসিস্তি [Faseisti] দলে যোগদান করে। সাহসী লোকপূর্ণ জগতে এরূপ অত্যাচারী সংঘের অস্তিত্বই থাকিবে না, এবং সে যুগের সৎলোকেরা প্রবৃত্তিগুলিকে এ যুগের মতো এমনভাবে বাধাও দিব না। কেবল নির্ভীক লোকেরাই এরূপ সুখের জগৎ সৃষ্টি করিতে এবং চালু রাখিতে পারে; তবে যতই তাহারা এ কাজে সফল হইবে ততই তাহাদের সাহস প্রয়োগের প্রয়োজন কমিয়া আসিবে।