বাল্যকালের পর কৌতূহলের তীব্রতা ও পরিমাণ কমিয়া আসে বটে কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত ইহার উৎকর্ষ বাড়িতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে কৌতূহল অপেক্ষা সাধারণ বিষয় সম্বন্ধে কৌতূহল উচ্চতরস্তরে বুদ্ধির পরিচয় দেয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, কৌতূহল উদ্রেককারী বিষয়বস্তু যত বেশি ব্যাপক হইবে ততই তাহা হইবে উচ্চতর বুদ্ধির পরিচায়ক। (তবে সকল ক্ষেত্রে এই সূত্রটিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করিয়া বুদ্ধির স্তর নির্ণয় করা হইবে না;) যাহার সঙ্গে বক্তিগত সুবিধা, যেমন খাবার সংগ্রহ করা, জড়িত নাই এমন বিষয়ের প্রতি কৌতূহল এই প্রবৃত্তিটির উত্তর্ষের নিদর্শন। যে-বিড়ালটি নূতন কক্ষের কোণে কোণে ঘ্রাণ লইয়া বেড়ায় তাহাকে নিছক বৈজ্ঞানিক গবেষক মনে করিলে চলিবে না; সে হয়তো দুরের সন্ধান পাওয়া যাইবে কি না তাহারই খোঁজ করিতেছে, স্বার্থসম্বন্ধবিহীন হইলেই যে কৌতূহল সর্বশ্রেষ্ঠ হইল তাহা বলা ঠিক হইবে না, বরং যখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ সাক্ষাৎ বা সুস্পষ্ট নয় কিন্তু বুদ্ধিপ্রয়োগ করায় অধিকার করা যায় তখন সে কৌতূহলকে অতি উচ্চস্তরের বলা যায়। যাহা হউক, এ বিষয়ে নির্ধারণ করা এখন আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
কৌতূহল ফলপ্রদ হইতে হইলে জ্ঞান অর্জনের কতকগুলি কৌশল ইহার সহিত সংযুক্ত হওয়া উচিত। পর্যবেক্ষণের অভ্যাস, জ্ঞানের সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে বিশ্বাস, ধৈর্য এবং পরিশ্রম একান্ত আবশ্যক। যদি আসল জিনিস অর্থাৎ কৌতূহল থাকে এবং তাহার সঙ্গে থাকে উপযুক্ত জ্ঞানাত্মক শিক্ষা তবে এ অভ্যাসগুলি আপনা আপনি বিকাশলাভ করিবে। কিন্তু সারা দিনমান আমরা যে কাজকর্মে লিপ্ত থাকি জ্ঞানাত্মক কাজ তাহার একটি অংশ মাত্র এবং নানা প্রবৃত্তির সঙ্গে কৌতূহলের অবিরত সংঘর্ষ হইতেছে; সেজন্য বুদ্ধিকে সজাগ রাখিয়া ঠিক পথে চালিত করার জন্য কতকগুলি জ্ঞানমূলক গুণের প্রয়োজন, যেমন ভোলা-মন সবকিছুকেই নিরপেক্ষভাবে যুক্তি দ্বারা যাচাই করিয়া দেখিবার অভ্যাস। আমাদের অভ্যাস এবং মনোবাসনা নূতন সত্যকে গ্রহণ করিতে স্বভাবতই নারাজ হয়। যাহা অনেক বছর ধরিয়া আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছি যাহা আমাদের আত্মসম্মান বা অন্য প্রধান প্রবৃত্তিগুলির পরিতৃপ্তি সাধন করিয়া আসিতেছে তাহা অবিশ্বাস করা কঠিন সন্দেহ নাই। কাজেই খোলা সতেজ মন গঠন করা শিক্ষার একটি কাম্য গুণ হওয়া উচিত।
বুদ্ধির সততা এবং দৈহিক শৌর্য প্রদর্শনের জন্য সাহসের একান্ত প্রয়োজন। এই বাস্তব জগতের যতখানি আমরা জানি বলিয়া মনে করি প্রকৃতপক্ষে জানি তাহার চেয়ে অনেক কম, জীবনের প্রথম দিন হইতে আমরা নানারূপ বাস্তব অবাস্তব সিদ্ধান্ত এবং অনুমান প্রয়োগ করিতে থাকি এবং প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে আমাদের মানসিক অভ্যাসগুলিকে তাল পাকাইয়া ফেলি। নানারকম বুদ্ধি পরিচালিত প্রতিষ্ঠান, যেমন খ্রিষ্টধর্ম, সাম্যবাদ, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি অনাথ আশ্রমের মতো সকলকে দাসত্বের বিনিময়ে নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। কোনো নীতিকে আশ্রয় করিলে জীবন নিরাপদ এবং আরামদায়ক হইতে পারে; কিন্তু স্বাধীনমনা ব্যক্তি যিনি দলে বা গোষ্ঠীতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মিশাইয়া দেন নাই, এরূপ আরামের জীবন লাভ করিতে পারেন না; বাহিরে যখন শীতের প্রবল ঝটিকা গর্জন করিয়া ফেলে কোনো একটি নীতিই কেবল মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দান করিতে পারে।
এই প্রসঙ্গে একটি কঠিন প্রশ্ন ওঠে; ভালো জীবনকে এইরূপে নীতি বা দল হইতে কতখানি মুক্ত করা উচিত আমি দলপ্রবৃত্তি বা যূথপ্রবৃত্তি [Hard instinct] কথাটি প্রয়োগ করিতে ইতস্তত করিতেছি; কেননা ইহার সত্যতা সম্বন্ধে বিরুদ্ধে অভিমত আসে কিন্তু যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হউক, এই প্রবৃত্তির স্বরূপ যাহা বর্ণনা করা হইয়াছে তাহার সহিত সকলেই পরিচিত। যে দলের সহিত আমরা সহযোগিতা করিতে চাই, তাহার সঙ্গে মিলিত হইতে আমরা পছন্দ করি–যেমন আমাদের পরিবার-পরিজন, আমাদের প্রতিবেশি, আমাদের সহকর্মী, আমাদের রাজনৈতিক দল কিংবা আমাদের জাতি। এরূপ মিলনের বাসনা স্বাভাবিক, কেননা সহযাগিতা ভিন্ন আমরা জীবনের কোনো আনন্দই উপভোগ করিতে পারি না। অধিকন্তু প্রক্ষোভ [Emotion] বা মানসিক ভাবাবেগ ছোঁয়াচে, বিশেষ করিয়া অনেক লোক একত্র হইয়া যখন ইহা অনুভব করে। একটি উত্তেজনাপূর্ণ জনসভায় উপস্থিত থাকিয়া খুব কম লোকই উত্তেজিত না হইয়া থাকিতে পারে। তাহারা যদি বিরুদ্ধ দলীয় হয়, তাহাদের বিরোধের ভাব প্রবল হইয়া ওঠে।
বেশিরভাগ লোকের পক্ষে এরূপ বিরোধিতা কেবল তখনই সম্ভবপর যখন তাহারা বুঝিতে পারে যে, অন্যত্র ভিন্ন জনতার মধ্যেও তাহারা তাহাদের কাজের জন্য প্রশংসা লাভ করিবে। এই জন্যই ঋষিদের মিলন [Communion of Saints] অত্যাচারিতদের মনে সান্ত্বনা দিতে পারিয়াছে। আমরা কি জনতার সঙ্গে সহযোগিতার বাসনা মানিয়া লইব, না আমাদের শিক্ষা ইহা শিথিল করিতে চেষ্টা করিবে? ইহার দুই পক্ষেই যুক্তি আছে; কোনো এক পক্ষের সম্পূর্ণ অনুকূলে অভিমত না দিয়া ইহার যথার্থ উত্তর হইবে দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত পরিমাণ নির্ণয়ে, কোনো এক পক্ষের সম্পূর্ণ অনুকূলে যে অভিমত তাহার মধ্যে নয়।