জ্ঞানোত্থিত অনুভূতি অর্থাৎ জ্ঞান হইতে যে অনুভূতি উদ্ভত হয় সেরূপ ভাবাবেগও প্রয়োজন। ইহাকে অন্য কথায় পর্যবেক্ষণের অভ্যাসও বলা যায়। বুদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে ইহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। সৌন্দর্যবোধের সাথে কতকগুলি সমস্যা জড়িত আছে; সেগুলি বর্তমানে আলোচনা করিতে চাই না। কাজেই উন্নত চরিত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য বুদ্ধি সম্বন্ধে আলোচনা করিব।
.
বুদ্ধি : প্রচলিত নীতি-জ্ঞানের একটি দোষ এই যে ইহা বুদ্ধির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে নাই। গ্রিকগণ ভুল করেন নাই কিন্তু খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ লোকের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করিয়া দিয়াছেন যে, কতকগুলি গুণ ছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের মূল্য নাই। গুণ বলিতে কি বোঝায়? কতকগুলি কাজকে তাহারা নিজেদের খেয়াল খুশিতো পাপ আখ্যা দিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। এ কাজগুলি হইতে বিরত থাকাই তাহাদের গুণের পরিচায়ক, যতদিন এই ধারণা প্রচলিত থাকিবে ততদিন এই তথাকথিত গুণ অপেক্ষা যে বুদ্ধি অনেক বেশি কাজে লাগে তাহা লোককে বুঝানো যাইবে না। বুদ্ধি বলিতে অর্জিত জ্ঞান এবং জ্ঞান গ্রহণের ক্ষমতা এ দুইটিই বুঝাইতেছি। বস্তুত এই দুইটি পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। মূর্খ বয়স্ক ব্যক্তিগণ জ্ঞান গ্রহণ করিতে অক্ষম; উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্বাস্থ্যনীতি বা খাদ্য সম্বন্ধে বিজ্ঞান যাহা বলে তাহা তাহারা কিছুতেই বিশ্বাস করিবে না। একজন লোক যত বেশি জানে, তাহাকে তত বেশি শিখানো সহজ, অবশ্য সে যদি কোনো প্রকার কুশিক্ষার ফলে মানসিক সংকীর্ণতা বা গোড়ামিতে অভ্যস্ত না হইয়া উঠিয়া থাকে। অজ্ঞ লোকেরা এমন অপরিবর্তনশীল, আড়ষ্ট মানসিক অভ্যাস গঠন করিয়া থাকে যে, তাহারা কিছুতেই তাহা বদলাইতে পারে না। যেখানে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ না করিয়া সহজে কিছু বিশ্বাস করা উচিত নয়, সেখানে অজ্ঞ ব্যক্তিরা অতি সহজেই বিশ্বাস করে; শুধু তাহাই নয়, যেখানে জ্ঞান গ্রহণ করা উচিত সেখানে তাহারা হয় অবিশ্বাসী। বুদ্ধি কথাটির যথাযথ অর্থ হইল অর্জিত জ্ঞান নয়, জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা বা মানসিক শক্তি। পিয়ানোবাদক বা দৈহিক কসরত প্রদর্শনকারী যেমন পুনঃ পুনঃ অনুশীলনের ফলে কৌশল আয়ত্ত করেন, জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা বা শক্তিও তেমনি চেষ্টা করিয়া আয়ত্ত করিতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন না করিয়াই অবশ্য শিক্ষাদান করা সম্ভবপর; শুধু সম্ভবপর নয়, এরূপ করা সহজ এবং প্রায়শই করা হইয়া থাকে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে, জ্ঞান দান ব্যতিরেকে বুদ্ধির অনুশীলন সম্ভব। বুদ্ধি ব্যতীত আমাদের বর্তমান জটিল জগৎ চলিতে পারে না, উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া তো অসম্ভব। এজন্য বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশকে আমি শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলিয়া মনে করি। মনে হইতে পারে, ইহা তো অতি সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা সেরূপ নয়। সত্য বিশ্বাস বলিয়া যাহা প্রচলিত সেগুলি ছাত্রদের মনে। অনুপ্রবিষ্ট করাইয়া দিতে গিয়া শিক্ষাবিদগণ অনেক সময় বুদ্ধির সম্যক শিক্ষণের প্রতি উদাসীন হইয়া পড়েন। এই বিষয়টি স্পষ্ট করিয়া বুঝাইতে গেলে বুদ্ধি কথাটি ভালভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার, কেননা ইহা দ্বারাই জানা যাইবে বুদ্ধির অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য কি কি মানসিক অভ্যাসের প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে অর্জিত জ্ঞানের কথা বাদ দিয়া জ্ঞান অর্জনের শক্তি সম্বন্ধেই আলোচনা করিব।
বুদ্ধিময় [Intellectual] জীবনের ভিত্তি হইল কৌতূহল প্রবৃত্তি। ইহা ইতর প্রাণীর মধ্যে প্রাথমিক আকারে দেখা যায়। বুদ্ধির জন্য চাই সদা-জাগ্রত কৌতূহল। কিন্তু ইহাও কোনো বিশেষ ধরনের হওয়া দরকার। পাড়াগাঁয়ে প্রতিবেশিরা সন্ধ্যার অন্ধকারে, পরদার আড়ালে উঁকিঝুঁকি মারে যে কৌতূহলের বশে, তাহার বিশেষ কোনো মূল্য নাই; খোশগল্প করার যে উৎসাহ, তাহাও জ্ঞানার্জনের বাসনা হইতে নয়; ইহা ঈর্ষা হইতে সঞ্জাত; কেহ অপরের গোপন গুণগুলির আলোচনা করিয়া খোশগল্পের আসর জমায় না, অপরের গুপ্ত দোষ সম্বন্ধে সরস রসালাপই হইল উপভোগের বিষয়। কাজেই অধিকাংশ খোশগল্পের মূলেই সত্য নাই, কিন্তু এগুলি সত্য কি না তাহা যাচাই করিয়া দেখার চেষ্টা হয় না। ধর্মের সান্ত্বনার মতো আমাদের প্রতিবেশির দোষগুলি আমাদের কাছে এত মুখরোচক যে, সে সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখার কোনো প্রয়োজন অনুভব করি না। পক্ষান্তরে প্রকৃত কৌতূহল জ্ঞানলাভের বাসনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। একটি বিড়াল নূতন অপরিচিত কোনো কক্ষে ছাড়িয়া দিলে ইহার আচরণে কৌতূহলের প্রকাশ দেখা যাইবে; ইহা তখন কক্ষের প্রতি কোনো এবং প্রতিটি আসবাব শুকিয়া দেখিবে। শিশুদের মধ্যেও ইহা দেখা যাইবে; কোনো বদ্ধ ড্রয়ার বা কাবার্ড তাহাদিগকে দেখাইবার জন্য খুলিলে তাহারা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত দেখিতে ঝুঁকিয়া পড়িবে। জীবজন্তুর, কলকবজা, বজ্রবিদ্যুৎ, বিভিন্ন রকমের হাতের কাজ শিশুদের কৌতূহল জাগ্রত করে। নূতন জিনিস জানিবার আগ্রহ তাহাদের এত বেশি যে, অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তিকেই লজ্জায় পড়িতে হয়। বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃত্তি ক্রমে কমিয়া আসে; অবশেষে এমন হয় যে, অজ্ঞাত বা অপরিচিত কোনো জিনিস মাত্রই বিরক্তি উৎপাদন করে। এই অবস্থায় পৌঁছিলে লোকে বলে, দেশটা জাহান্নামে যাইতেছে, আর বলে আমাদের ছোট বয়সে যেমন ছিল দিনকাল আর এখন তেমন নেই। সে জিনিসটি অতীতে যাহা ছিল, এখন তাহা নাই, তাহা হইল বক্তার কৌতূহল। কৌতূহলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, আমরা ধরিয়া লইতে পারি যে, সক্রিয় বুদ্ধিরও মৃত্যু ঘটিয়াছে।