প্রকৃতি মুক্ত এবং বুদ্ধি সক্রিয় না থাকিলে এরূপ ঘটিতে পারে না। এই দুইটির মিলনের ফলে দৃষ্টিভঙ্গির এমন উদারতা এবং ব্যাপকতা জন্মে যে, তাহা ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং সংযমী ঋষি উভয়েরই কাছে অজ্ঞাত; এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির নিকট ব্যক্তিগত মৃত্যু অকিঞ্চিৎকর বলিয়া মনে হয়। এই সাহস অস্থি-মূলক [positive] এবং প্রবৃত্তি সজ্ঞাত, নেতিমূলক [Negative] ও দমনমূলক নয়।
.
অনুভূতিশীলতা : এক হিসাবে অনুভূতিশীলতাকে সাহসের সংশোধন বলা যায়। যে-ব্যক্তি বিপদ সম্বন্ধে ধারণা বা অনুভব করিতে পারে না তাহার পক্ষে সাহসীর ন্যায় আচরণ করা সহজ; এইরূপ সাহস প্রায় মূর্খতার শামিল। অজ্ঞতা বা বিস্মৃতির ফলে যে কাজ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে কখনোই সন্তোষজনক বলা যায় না। কোনো কাজের মূলে যথাসম্ভব সম্পূর্ণ জ্ঞান এবং তাহার সম্বন্ধে ধারণা বিদ্যমান থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে গেলে বুদ্ধির কথা ওঠে; আমি এখানে অনুভূতিশীলতাকে মনের ভাব বা প্রক্ষোভের পর্যায়ে ফেলিয়াছি। ইহার সহজ ব্যাখ্যা এইভাবে করা যায় : যখন অনেকগুলি ঘটনা কোনো ব্যক্তির মনে নানা প্রক্ষোভের [Emotions] সৃষ্টি করিয়া নানা ভাব জাগাইয়া তোলে তখন বলা যায় যে, সে অনুভূতিশীল হইয়া উঠিয়াছে; ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করিলে এই মানসিক অবস্থা কল্যাণকর না-ও হইতে পারে! ভালো হইতে হইলে মনের উপর এই অনুভূতির প্রতিক্রিয়া যথাযথ হওয়া দরকার; শুধু প্রতিক্রিয়ার তীব্রতার প্রয়োজন নাই। বাহিরের সুখদুঃখ আনন্দ-বেদনাময় ঘটনায় মনে অনুরূপ অনুভূতি জাগরিত হউক ইহাই আমার কাম্য। আনন্দময় ঘটনা মনে আনন্দের অনুভূতি জাগাইবে, দুঃখময় ঘটনা মনে বেদনার অনুভূতি জাগাইবে ইহাকেই বলা চলে যথাযথ প্রতিক্রিয়া।
যথার্থ বিষয় কি তাহাই বুঝাইতে চেষ্টা করিব। শিশুর বয়স যখন পাঁচ মাসের মতো তখন খাদ্য এবং কোমল উষ্ণতায় সে যে আনন্দ অনুভব করে তাহা ছাড়াইয়া আরও একটি নূতন অনুভূতি। এই অনুভূতি খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। প্রত্যেক শিশুই প্রশংসা ভালোবাসে, দোষারোপ অপছন্দ করে। সাধারণত লোকে ভাল বলুক এই ইচ্ছা মানুষের সারা জীবন ধরিয়া প্রবল থাকে। অপরের প্রশংসা লাভ করার বাসনা মানুষকে মনোজ্ঞ আচরণ করিতে উৎসাহিত করে। তাহার লোভের প্রবৃত্তি দমন রাখিতে সাহায্য করে। কোন্ কোন্ গুণ প্রকৃতই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য সে সম্বন্ধে আমরা যদি কিছু বিচক্ষণতার পরিচয় দিতাম, তবে ফল অনেক ভালো হইত। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের হত্যাকারীকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বলিয়া প্রশংসা করা হইবে, ততদিন শিশুর প্রশংসালাভের বাসনাকেই ভালো জীবন গঠনের একমাত্র উপাদান হিসাবে গ্রহণ করা যাইবে না। দিগ্বিজয়ী বীরের প্রশংসা শুনিয়া বালক নিজেও প্রশংসিত ব্যক্তির গুণাবলি অনুকরণ করিতে চেষ্টা করে; যাহাকে সে বীর বলিয়া অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাহার গুণগুলি তাহার কাছে সহনীয় মনে হয়। এইভাবে প্রকারান্তরে সে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার নিষ্ঠুরতাকে গুণ বলিয়া বরণ করিয়া নেয় এবং নিজের জীবনেও অনুকরণ করে।
অনুভূতিশীলতা বিকাশের দ্বিতীয় সোপান হইল সমবেদনা। এক রকম সমবেদনা আছে যাহা দৈহিক–যেমন ছোট শিশু তাহার ভাই বা বোনকে কাঁদিতে দেখিলে নিজেও কাঁদিতে শুরু করে। এই সূত্র অবলম্বন করিয়া সমবেদনা বিকাশের সুযোগ কাজে লাগানো যায়। স্বাভাবিক সহানুভূতি বোধকে দুইদিকে বাড়ানো দরকার প্রথম, বিপন্ন ব্যক্তি বিশেষ স্নেহের পাত্র না হইলেও তাহার দুঃখে সহানুভূতি বোধ করা; দ্বিতীয়, যখন বিপন্ন ব্যক্তি চোখের সামনে নেই, তখন তাহাদের দুঃখদুর্দশার কথা শুনিয়াই সমবেদনা বোধ করা। এই দ্বিতীয় উপায়ে সমবেদনা বোধ করা প্রধানত বুদ্ধির উপর নির্ভর করে। ভালো উপন্যাসে দুঃখ-দুর্দশার জীবন্ত বর্ণনা পাঠ করিয়া পাঠক সমবেদনা বোধ করিতে পারে; আবার ইহা (বুদ্ধি) এমন উৎকর্ষ লাভ করিতে পারে যাহার ফলে পরিসংখ্যান [Statistics] দেখিয়াই কেহ সহানুভূতিতে বিগলিত হইতে পারেন। নিজের প্রিয়জনের কর্কটরোগ [Cancer] হইলে প্রায় সকলেই সমবেদনায় উদ্বেল হইয়া ওঠেন। বেশিরভাগ লোক হাসপাতালে অপরিচিত রোগীর যন্ত্রণা দেখিয়া বিচলিত হয়। অথচ যখন তাহারা পড়ে যে, কর্কটরোগে মৃত্যুর হার বাড়িয়াছে তখন তাহারা তাহাদের নিজেদের ওই রোগ হইতে পারে; কিংবা তাহাদের প্রিয়জনের হইতে পারে এই আশংকায় সাময়িকভাবে বিচলিত হয় মাত্র। যুদ্ধ সম্বন্ধে এ কথা খাটে। যাহাদের ছেলে বা ভাই যুদ্ধে বিকলাঙ্গ হয় তাহারা যুদ্ধকে ভয়ঙ্কর মনে করে; আরও লক্ষ লোক যে বিকলাঙ্গ হইতে পারে তাহা ভাবিয়া তাহারা যুদ্ধকে লক্ষ গুণ ভয়ঙ্কর মনে করে না। যিনি ব্যক্তিগত আচরণে সহৃদয়তার পরিচয় দেন তিনিও যুদ্ধে উত্তেজনা দান ব্যাপার হইতে কিংবা অনুন্নত দেশে শিশুদের উপর অত্যাচার চালনা হইতে অর্থোপার্জন করেন। এই সকল পরিচিত ঘটনার কারণ হইল এই যে, বস্তু-নিরপেক্ষ [Abstract] কোনো তথ্য বেশিরভাগ লোকের মনে সহানুভূতি জাগাইতে পারে না। জাগাইতে পারিলে বর্তমান জগতের অনেক অন্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব হইত। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদিগকে দূরবর্তী দেশের মানবগোষ্ঠীর উপরও প্রভাব বিস্তার করিতে সক্ষম করিয়াছে কিন্তু তাহাদের জন্য সহানুভূতি বোধ বৃদ্ধি করে নাই। মনে করুন, আপনি সাংহাইতে তুলা উৎপাদন ব্যবসাতে লিপ্ত কোনো কোম্পানির অংশীদার। আপনি হয়তো কর্মব্যস্ত লোক; ব্যবসায়ী উপদেষ্টার পরামর্শক্রমেই আপনি টাকা খাটাইতেছেন; সাংহাই বা তুলা ব্যবসা কোনওটি সম্বন্ধেই আপনার কৌতূহল নাই, আপনি কেবল চান লাভের টাকা। তবু নিরীহ লোকেদের হত্যার ব্যাপারে আপনি অংশ গ্রহণ করিতেছেন এবং ছোট ছোট বালক-বালিকাকে অস্বাভাবিক ও বিপজ্জনক কাজে না খাটাইলে আপনার লাভের অঙ্কে শূন্য পড়িবে। আপনার মনে কোনও ভাবান্তর হয় না, কেননা আপনি সেখানকার বালক-বালিকাদিগকে দেখেন নাই এবং শুধু তথ্য আপনাকে বিচলিত করিতে পারে না। বৃহদাকারের যন্ত্রশিল্প যে এত নির্মম কেন এবং পরাধীন জাতির অধিবাসীদের উপর অত্যাচার যে বিজয়ী জাতির লোকে সহ্য করে কেন তাহার মূল কারণ ইহাই। যদি এমন শিক্ষা দেওয়া যায় যাহার সাহয্যে বস্তু নিরপেক্ষ তথ্য দ্বারাও অনুভূতি জাগানো সম্ভব, তাহা হইলে সেই শিক্ষাই এরূপ অবিচার ও অত্যাচারের বিলোপ ঘটাইবে।