মনস্তত্ত্ব ও শারীরবিজ্ঞানের দিক দিয়া ভয় এবং ক্রোধ একই জাতীয় প্রক্ষোভ [Emotion]; ক্রুদ্ধ ব্যক্তি উন্নত ধরনের সাহস প্রদর্শন করিতে পারে না। নিগ্রো বিদ্রোহ দমনে, কমিউনিস্ট বিপ্লব দমনে এবং আভিজাত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল রকম আন্দোলন দমন করিতে যে নিষ্ঠুরতা দেখানো হইয়াছে তাহা কাপুরুষতা হইতেই উৎপন্ন। কাপুরুষতা স্কুল প্রকাশ যেরূপ ঘৃণার যোগ্য, এ আচরণ তেমনি নিন্দনীয়। আমি বিশ্বাস করি যে, সাধারণ স্ত্রী পুরুষকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া যায় যাহাতে তাহারা ভয়শূন্য হইয়া জীবনযাপন করিতে পারে। এ পর্যন্ত কেবল বড় বড় ঋষিরাই এরূপ জীবনযাপন করিয়াছেন; কিন্তু উপায় দেখাইয়া দিলে সাধারণ লোকেও নির্ভীকতা লাভ করিতে পারে।
যে সাহসের অর্থ কেবল দমন করা নয়, সেরূপ প্রকৃত সাহস অর্জন করিতে হইলে কতকগুলি বিষয় দরকার। প্রথমেই বলা যায় স্বাস্থ্য এবং উদ্যম। এ-দুইটি সম্পূর্ণ অপরিহার্য না হইলেও বিশেষ সহায়ক। বিপদজ্জনক অবস্থা হইতে উদ্ধার হওয়ার অভ্যাস এবং কৌশলও বিশেষ বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা যখন কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রদর্শিত সাহস নয়, সাধারণ সাহসের কথা বিবেচনা করি তখন আরও মৌলিক [fundamental] কতকগুলি গুণের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ইহা সকল আত্মসম্মান এবং জীবনের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক [impersonal] দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণ। প্রথমে আত্মসম্মানের কথা আলোচনা করি :–কতক লোক নিজেদের অন্তরের মধ্যে বাস করেন এবং নিজেদের বিচার বুদ্ধি এবং বিবেক দ্বারা পরিচালিত হন, আর কতক লোক তাহাদের প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবের দর্পণস্বরূপ, অপরের অনুভূতি এবং অভিমত দ্বারা পরিচালিত হন। এরূপ লোকের সত্যকারের সাহস থাকিতে পারে না। ইহারা প্রশংসার কাঙাল, প্রশংসা নষ্ট হইবে এই ভয়ে ইহারা ভীত। বিনয়, নম্রতা, শিক্ষা এক সময় বাঞ্চনীয় মনে করা হইত; ইহার কুফল ফলিয়াছে। নম্রতা অর্জন করিতে ইচ্ছুক লোকদিগকে আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হইয়াছে কিন্তু তাহারা অপরের নিকট হইতে শ্রদ্ধা পাইবার বাসনা ত্যাগ করে নাই। ম হওয়া, আত্মসম্মান বিকাইয়া দেওয়া ইহারা লোকের বাহবা পাওয়ার উপায় বলিয়া মনে করিয়াছে। এইভাবে মিথ্যাচার এবং ভণ্ডামি প্রশ্রয় পাইয়াছে। শিশুদিগকে যুক্তি দিয়া বুঝাইয়াই আদেশ মানিয়া লইতে শিখানো হইত না; তাহাদের বয়স বেশি হইলে তাহারাও অন্যের নিকট হইতে এইরূপ নতি স্বীকার দাবি করিত; বলা হইত যে, যাহারা আদেশ মান্য করিতে জানে, কেবল তাহারাই আদেশ করিতেও জানি। আমি বলি কি আদেশ মান্য করার শিক্ষার প্রয়োজন নাই, কাহাকেও আদেশ দান করারও প্রয়োজন নাই। অবশ্য আমি একথা বলি না যে, সহযোগিতামূলক সমবায় পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত কোনো কাজে কোনো নেতা থাকিবে না; ফুটবল-দলের অধিনায়কের নির্দেশ যেমন সকলে স্বেচ্ছায় মানিয়া চলে, তেমনি একই উদ্দেশ্যসাধনের ব্যাপারে সফর নেতার আদেশ সানন্দে এবং স্বেচ্ছায় মানিয়া চলিবে। এই উদ্দেশ্য যেন আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য হয়, বাহির হইতে কেহ যেন আমাদের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দিয়া তাহা সাধন করিতে হুকুম না করে। কাহারও আদেশ করার দরকার নাই, কাহারও আদেশ পালন করারও প্রয়োজন নাই একথা বলিতে আমি ইহাই বুঝাইতে চাই।
সর্বশ্রেষ্ঠ সাহস প্রদর্শনের জন্য আরও একটি জিনিসের কথা বলা হইয়াছে; তাহা হইল জীবনের প্রতি নৈর্ব্যত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। যে ব্যক্তি অতিমাত্রায় আত্মসর্বস্ব, যাহার আশা, ভয় সমস্ত কিছুই কেবল নিজেকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হয়, সে প্রশান্তচিত্তে মৃত্যুবরণ করিতে পারে না; কেননা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাহার ভাব ও আশা-আকাঙ্ক্ষা জগতের পরিসমাপ্তি ঘটে। এখানেও আমরা আত্মদমনের একটা সহজ পন্থা প্রচলিত দেখি; সাধুব্যক্তিকে আত্মবর্জন করিতে হইবে, দেহের কষ্ট বরণ করিতে হইবে, স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত আনন্দ উপভোগ পরিত্যাগ করিতে হইবে। এইরূপ করা যায়, কিন্তু ইহার ফল হয় খারাপ। নিজের সুখ বর্জন করিয়া ত্যাগী সন্ন্যাসী ব্যক্তি অপরের পক্ষেও ইহা বর্জনীয় মনে করে। এইরূপ মনে করা সহজ। আত্মনিপীড়নকারী ব্যক্তি বুঝিতে পারে না কিন্তু সংসারের ভোগীদের প্রতি ঈষা তাহার মনের গভীরে ফল্পর স্রোতের মতো বহিত থাকে; তিনি মনে করেন শারীরিক দুঃখকষ্ট সহ্য করা সহনীয় কাজ, কাজেই ন্যায়সঙ্গতভাবেই ইহা অন্যের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া যায়। এইভাবে জীবনের মূল্য সম্বন্ধেই, এক সম্পূর্ণ ভুল এবং বিপরীত ধারণার সৃষ্টি হয়। যাহা ভালো তাহাকে মনে হয় মন্দ এবং যাহা মন্দ তাহাকেই মনে হয় ভালো। এইসব ক্ষতির মূল কারণ হইল স্বাভাবিক বাসনা ও প্রবৃত্তিগুলির বৃদ্ধি এবং বিকাশ না ঘটাইয়া নীতিমূলক আদর্শের সাহায্যে মহৎ জীবন গঠনের চেষ্টা। মানুষের স্বভাবে এমন কতকগুলি জিনিস আছে যাহা বিনা চেষ্টাতেই আমাদিগকে আমাদের সত্তার উর্ধ্বে লইয়া যাইতে পারে। ইহাদের প্রধান হইল প্রীতি, বিশেষ করিয়া জনক-জননীর বাৎসল্য। কোনো কোনো লোকের মধ্যে এই প্রীতি এমন ব্যাপক যে সমগ্র মানবজাতিকে তাঁহারা প্রীতি-পাশে আবদ্ধ করিতে পারেন। অন্য বিষয়টি হইল জ্ঞান। গ্যালিলিও যে বিশ্বের কল্যাণকামী ঋষি-প্রকৃতির লোক ছিলেন এমন অনুমান করিবার কোনো কারণ নাই, তথাপি জ্ঞানের সাধনায় তিনি যাহা সত্য বলিয়া স্থির বিশ্বাস করিয়াছিলেন তাহার নজ্য জীবন দিতে তিনি কুণ্ঠিত হন নাই। অপর বিষয় হইল শিল্প। প্রকৃতপক্ষে মানুষে নিজের দেহ ছাড়া বাহিরের জিনিসের দিকে যে পরিমাণ আকৃষ্ট হইবে ততই তাহার জীবনের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিও সেই পরিমাণে বাড়িবে। এইজন্য, শুনিতে স্বয়ং বিরোধী মনে হইলেও, ইহা সত্য যে, যে-ব্যক্তি বহির্জগতের নানা বিষয়ে দীপ্ত উৎসাহ দেখাইয়া থাকে সে যত সহজে জীবনের মায়া কাটাইতে পারে। একজন হতভাগ্য, সর্বদা অমূলক রোগের ভয়ে শঙ্কিত, মনোবিকারগ্রস্ত রোগী তত সহজে প্রাণের মায়া কাটাইতে পারে না। এমন মানুষের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়, যিনি নিজের সত্তাকে বিশ্বের একটি অংশ বলিয়া অনুভব করন–নিজেকে হেয় করিয়া নয়, নিজের জীবন ছাড়া অন্য কোনো জিনিসকে জীবনের চেয়ে মহত্তর বলিয়া মনে করিয়া।