.
সাহস : সাহসের কয়েকটি প্রকার আছে এবং সব কয়টিই জটিল। ভয়শূন্যতা এক জিনিস এবং ভয় দমন করিবার ক্ষমতা অন্য জিনিস। বাস্তব এবং যুক্তিসঙ্গত ভয় হইতে মুক্ত থাকা এক কথা, অবাস্তব বা অযৌক্তিক ভয় হইতে মুক্ত থাকা অন্য কথা। অবাস্তব ভয় না থাকা খুবই ভালো; ভয়কে দমন করার শক্তিও প্রশংসনীয়। কিন্তু ভয় যেখানে যুক্তিসঙ্গত সেখানেও যদি ভয়শূন্যতা থাকে তবে তাহা কিসের দ্যোতক, তাহার ফলাফলই বা কি হইতে পারে সে সম্বন্ধে তর্ক চলিতে পারে। যাহা হউক, আপাতত: এ তর্ক স্থগিত রাখিয়া সাহসের অন্য স্বরূপ সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক।
বেশিরভাগ লোকের ভাব-জীবনে [Emotional life] অবাস্তব ভীতি একটি প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে। অকারণ উৎপীড়নের আশঙ্কা, বিনা কারণে অমূলক উৎকৃষ্ঠা বোধ করা প্রভৃতি উৎকট মানসিক রোগের প্রকৃতি নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য উন্মুদ রোগীর চিকিৎসকের প্রয়োজন। এগুলি যাহাদের মধ্যে তীব্র আকারে প্রকাশ পায় তাহারা উন্মাদের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু মৃদু আকারে এরূপ ভাব অনেক সুস্থ ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যায়। কাহারও এরূপ বোধ হইতে পারে যে, তাহার চারিদিকে বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে; হঠাৎ কোনো কিছু ঘটিতে পারে; ইহাকেই বলা চলে উৎকণ্ঠা, কাহারও বা হয়তো কোনো কিছু ভয়ের ভাব বদ্ধমূল হইয়াছে, অথচ প্রকৃতই তাহাতে ভয়ের কিছু নাই, যেমন ইঁদুর বা মাকড়সা দেখিয়া ভয় পাওয়া। আগে মনে করা হইত যে, ভয় মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি অর্থাৎ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কতকগুলি প্রবৃত্তির মতো ভয়ও সে লাভ করে কিন্তু বর্তমান গবেষকগণের অধিকাংশই এখন ইহা মানেন না। বাহ্যত জন্মগত কয়েকটি ভয় আছে, যেমন উচ্চ শব্দ শুনিয়া ভয়; কিন্তু বেশিরভাগ ভয়ের উৎপত্তি হয় অভিজ্ঞতা হইতে আর না হয় অন্যের সংস্পর্শ হইতে। অন্ধকার দেখিয়া ভীত হওয়া সম্পূর্ণরূপে অন্যের কাছে পাওয়া। এরূপ মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের স্বভাব শত্রু সম্বন্ধে তাহাদের কোনো ভীতিবোধ থাকে না; ইহা তাহারা তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে লাভ করে। মানুষ যখন ইহাদিগকে হাতে করিয়া লালন-পালন করে তখন ইহাদের গোষ্ঠীর অন্যান্যদের মধ্যে যে ভয় স্বাভাবিক তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইহা অত্যন্ত সংক্রামক। শিশুরা তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে ইহা পায়, এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠরা হয়তো জানিতেই পারিলেন না কখন কিভাবে তাহারা ভীতির ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। জননী বা ধাত্রীর ভীরুতা শিশু অতি শীঘ্র অনুকরণ করে। এতদিন পুরুষেরা মনে করিয়াছেন যে অবাস্তব ভয়ে ভীত থাকিলে স্ত্রীলোকের আকর্ষণ বাড়ে কেননা ইহার ফলে তাহারা প্রকৃত কোনো বিপদের সম্মুখিন না হইয়াও বিপন্ন মহিলাদের রক্ষক সাজিবার সুযোগ পাইতেন, কিন্তু ইহাদের পুত্রগণ তাহাদের জননীর নিকট হইতে ভয় অর্জন করিয়াছে। অথচ পুরুষগণ যদি স্ত্রীলোকদিগকে এভাবে অশ্রদ্ধা না করিত তবে তাহাদের সন্তানগণ ভীত হইয়া পড়িয়া উঠিত না। [শিক্ষার ভিতর দিয়া তাহাদের ভয় দূর করিয়া সাহসী করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে হয়। স্ত্রীলোকদিগকে অধীন করিয়া রাখা অপরিসীম ক্ষতির কারণ হইয়াছে; সন্তানের মনে ভয়সঞ্চার ইহার কেবল একটি উদাহরণ মাত্র।
কি উপায়ে ভয় এবং উৎকণ্ঠা কামানো যায় এখন তাহার আলোচনা করিতেছি; পরে এ বিষয়ে আলোচনা হইবে। এখন একটি প্রশ্ন উঠে: ভয় চাপিয়া রাখিয়াই কি আমরা সন্তুষ্ট থাকিব, না ইহার কারণেই মূলোচ্ছেদ করিতে হইবে? ঐতিহ্য এইভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে যে, অভিজাত সম্প্রদায় কোনো প্রকার ভয় ভীত হইবে না; পরাধীন জাতির লোকজন, সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ এবং স্ত্রীলোকদিগের ভীরু হইয়া থাকিতে উৎসাহিত করা হইয়াছে। বাহিরের আচরণ দ্বারা এর সাহসের প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে–সাহসী ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পালাইবে না; পুরুষোচিত খেলাধুলায় সে পারদর্শী হইবে; অগ্নিকাণ্ড, জাহাজডুবি, ভূমিকম্প প্রভৃতির সময় সে আত্মসংযম হারাইয়া ফেলিবে না। সাহসের পরিচয় দিতে গিয়া যখন যাহা করা দরকার সে শুধু তাহাই করিবে না, ভয়ের কোনোরূপ চিহ্ন যেন যাহাতে তাহার আচরণে বা দেহে প্রকাশ না পায় যেমন বিবর্ণ হইয়া যাওয়া, কাপিতে থাকা, ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলা প্রভৃতি–তাহাই করিতে হইবে। এ সমস্ত খুবই প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান; পৃথিবীর সকল জাতির, সকল শ্রেণির পুরুষ ও নারী সকলের মধ্যেই সাহসের উদ্বোধন ঘটুক ইহাই আমি দেখিতে চাই। কিন্তু যখন ভয় দমন করিয়া বা চাপিয়া রাখিয়া সাহসের ভাব দেখানো হয় তখন দমন করার দরুন কুফলের হাত এড়ানো যায় না। লজ্জা ও অপমান সর্বদা সাহস উৎপাদনের প্রধান উপায় আছে; কার্যত কিন্তু ইহা দুইটি ভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব মাত্র–ভয় এবং ভয়ে ভীত হইলে অন্যের নিকট হইতে লজ্জা পাওয়ার ভয়; এই দুই ভয়ের দ্বন্দ্বে সাধারণের নিকট অপমানিত হওয়ার ভয়ই প্রবল হয়। এবং অপমানের হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে সাহস প্রদর্শন করে। বাল্যকালে আমাকে শিখানো হইত যখন তোমাকে কোনো কিছু ভয় দেখায় তখন ছাড়া অন্য সব সময় সত্য কথা বলিবে। সময় সময় যে সত্যকথার ব্যতিক্রম করা উচিত তাহা মানি না! ভয়কে জয় করিতে হইবে, শুধু কাজে নয়, চিন্তাতেও। কেবল সজ্ঞান চিন্তাতে নয়, নিজ্ঞান [Unconscious] চিন্তাতেও। [ভয়ের সম্মুখিন হইয়াও অনেক সময় মানুষ লোকলজ্জার ভয়ে সাহসের পরিচয় দেয়। এক্ষেত্রে লোকভয় তাহার প্রাথমিক ভয়কে জয় করিয়াছে; সাহসীর মতো আচরণের মধ্যে এই জয়ের অভিব্যক্তি দেখা দেয়। অভিজাতের রীতি অনুযায়ী ভয়কে বাহ্যত জয় করা হইল বটে, কিন্তু আসল ভাবটির মনের গহনে প্রবেশ এমন নূতন আকারে আত্মপ্রকাশ করে যে, সেটি যে ভয় হইতেই সঞ্জাত তাহা বুঝিবার উপায় থাকে না। কামানের গোলার ভীতির কথা বলিতেছি না; সেক্ষেত্রে ভয় সুস্পষ্ট। প্রতিপত্তিশালী জাতিসমূহ যে অত্যাচার এবং নিষ্ঠুরতার সাহায্যে তাহাদের প্রাধান্য বজায় রাখে–আমি তাহার কথাই চিন্তা করিতেছি। কিছুদিন আগে একজন ব্রিটিশ কর্মচারী সাংহাইতে একদল নিরস্ত্র চীনা ছাত্রকে সতর্ক করিয়া না দিয়া পিঠের দিক হইতে গুলি করিয়া মারিবার নির্দেশ দিয়াছিল। যেরূপ ভীত হইলে একজন সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করে, তখন সেই কর্মচারীটিও নিশ্চয়ই ঠিক তেমনি ভীত হইয়াছিল। কিন্তু যোদ্ধার অভিজাত সম্প্রদায়ের এতখানি বুদ্ধি নাই যে, এইরূপ ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক কারণ নির্ণয় করিতে পারে; তাহারা বরং ইহাকে দৃঢ় এবং উপযুক্ত মনোভাব প্রদর্শন বলিয়াই মনে করে।