শিক্ষাবিদগণ যে ছাত্রকে ভালোবাসিবেন ইহাই যথেষ্ট নয়; কি কি গুণে ভূষিত হইলে মানুষের উৎকর্ষতা বাড়ে সে সম্বন্ধেও তাহাদের সঠিক ধারণা থাকা চাই। বিড়াল তাহার ছানার সঙ্গে খেলা করে এবং ইঁদুর ধরা শিখায়, যুদ্ধবাদীগণ [Mil itarists] অনুরূপভাবে মানব শিশুকে শিক্ষা দেন। বিড়াল তাহার নিজের ছানাকে ভালবাসে কিন্তু ইঁদুর ছানাকে ভালোবাসে না, যুদ্ধবাদী সন্তানদিগকে ভালোবাসে না। যাহারা সমগ্র মানবজাতিকে ভালোবাসেন তাহারাও উৎকৃষ্ট জীবনের উপাদান কী সে সম্বন্ধে ভুল ধারণা পোষণ করার ফলে ভুল পথে চলিতে পারেন। কাজেই কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া কিংবা কোনো গুণ অধিগত করা (ইহা আদৌ) সম্ভবপর কিনা তাহা চিন্তা না করিয়া, মানবজীবনে চরম উৎকর্ষলাভের জন্য কিসের প্রয়োজন তাহাই প্রথমে আলোচনা করিব। পরে, যখন আমরা শিক্ষার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব, তখন ইহা কাজে লাগিবে; তখন বুঝিতে পারিব কোন্ লক্ষ্য অভিমুখে আমরা চলিতে চাই।
আমরা প্রথমেই একটা পার্থক্যের কথা স্বীকার করিয়া লই :–এমন কিছু গুণ আছে যাহা সকলের মধ্যে না হোক কিছুসংখ্যক লোকের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়, আবার কতকগুলি গুণ সর্বজনীন হওয়া উচিত। আমরা শিল্পী চাই কিন্তু বৈজ্ঞানিকও আমরা চাই। আমরা রাষ্ট্র পরিচালক ও শাসক চাই, আবার কৃষক, মজুর, ব্যবসায়ীও তো চাই। যে গুণাবলি একজন লোকের জীবনে বিরাট প্রতিভারূপে প্রকাশ পায় তাহাই সর্বসাধারণের মধ্যে বিকশিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। শেলি একজন কবির দিনের কাজের বর্ণনা দিয়াছেন এইরূপ :
প্রভাত সময় হতে প্রদোষ অবধি।
দেখিবে সে হ্রদতীরে বসি
রৌদ্রকরে উল্লসিত মৌমাছির মেলা
ফুলে ফুলে। বস্তুপুঞ্জে নাহি আকর্ষণ,
নিমগ্ন সুন্দরের ধ্যানে।
কবির পক্ষে এই অভ্যাস প্রশংসনীয় কিন্তু ডাকপিওনের পক্ষে নয়। কাজেই সকলের মধ্যেই স্বভাব বা মনোভাব গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্যে আমরা কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে পারি না। কিন্তু কতকগুলি গুণ সকলের মধ্যেই বিকশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়; কেবল এইগুলিই এখানে বিবেচনা করিব।
এই গুণসমূহের কোনগুলি পুরুষের পক্ষে প্রযোজ্য, কোন্গুলি স্ত্রীলোকের পক্ষে প্রযোজ্য সে সম্বন্ধে কোনো পার্থক্য করিতে চাই না। যে সকল স্ত্রীলোককে শিশুর যত্ন পরিচর্যা করিতে হয় তাঁহাদের জন্য পেশামূলক কিছু শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা উচিত, একজন কৃষক ও একজন মিলচালক বা মজুরের মধ্যে শিক্ষার যা পার্থক্য এ ক্ষেত্রেও পার্থক্য প্রায় সেইরূপ। এ পার্থক্য মূলনীতিগত নয় এবং ইহা লইয়া এ পর্যায়ে আলোচনারও প্রয়োজন নাই।
যে চারিটি বৈশিষ্ট্য একত্র মিলিত হইয়া আদর্শ চরিত্র গঠন করিতে পারে প্রথমে তাহারই উল্লেখ করা হইতেছে : উৎসাহ-উদ্দীপনা (উদ্যম), সাহস, অনুভূতিশীলতা এবং বুদ্ধি। মানব চরিত্রে গুণাবলির পক্ষে এই তালিকাই যে সম্পূর্ণ, তাহা বলি না কিন্তু ইহার মধ্যে অনেকগুলি অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। অধিকন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে যথোপযুক্তভাবে দেহমনের যত্ন লইলে এইগুলি প্রায় সকলের মধ্যেই বিকশিত করা যায়। একে একে ইহাদের আলোচনা করা যাক।
.
উদ্যম : উদ্যমকে মানসিক বৈশিষ্ট্য না বলিয়া বরং দৈহিক বৈশিষ্ট্য বলা যায়। যেখানেই ভালো স্বাস্থ্য সেখানেই উদ্যম বিদ্যমান; বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইহা কমিতে থাকে এবং বার্ধক্যে শেষ হইয়া যায়। স্বাস্থ্যবান শিশুদের বেলায় তাহাদের স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগেই ইহা পূর্ণমাত্রায় বিকাশ লাভ করে, শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে ক্রমে কমিতে থাকে। দেহের সবল, সুস্থভাবে বাঁচিয়া থাকার আনন্দ বাড়াইয়া দেয়, কষ্টবোধ হ্রাস করে। উদ্যমশীল শিশু যাহা দেখে সবকিছুতে কৌতূহল বোধ করে এবং নানা জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হয়। বহির্জগতে নানা বিষয়ের সংস্পর্শে আসিয়াই শিশু তাহার বিচারবুদ্ধির পরিচয় দেয়। মানুষ তাহার চতুর্দিকে যাহা কিছু দেখে বা শেখে তাহাতে যদি কোনো প্রকার আনন্দ না পায়, তবে স্বভাবতই সে (নিজের ভিতরেই ইহার সন্ধানে ডুবিয়া যায়) আত্মস্থ হইয়া পড়ে। ইহা দুভার্গের কারণ হইয়া পড়ে কেননা বহির্জগতের আনন্দ উপভোগে অসমর্থ, নিরানন্দ লোকের জীবনে প্রথমে আসে অবসাদ; ইহাই ক্রমে বিষণ্ণতা ও মানসিক রোগে পরিণত হয়। অতি অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মানসিক বিষণ্ণতা জীবনকে অকেজো করিয়া ফেলে। উদ্যম বহির্জগতের প্রতি মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে; ইহা কাজের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। উদ্যম মানুষের জীবনকে আনন্দময় করে; ইহা ঈষার বড় প্রতিষেধক। মানুষের মনঃকষ্টের একটি বড় কারণ পরশ্রীকারতা। এই পরশ্রীকাতরতা উদ্যমশীল লোকের আনন্দময় জীবনে ঘেঁসিতে পারে না। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহের উদ্যমের সঙ্গে অনেক দোষ যুক্ত থাকিতে পারে; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটি সরল সুস্থ বাঘের কথা। আবার উজ্জ্বল স্বাস্থ্যের অভাব থাকিলেও লোকের অনেক গুণ থাকিতে পারে। উদাহরণ দেওয়া যায়–নিউটন [Newton] এবং লক [Locke] উভয়েরই স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। এ দুজনেই ছিল খিটখিটে মেজাজসম্পন্ন এবং ঈর্ষাপরায়ণ। ইহারা স্বাস্থ্যবান হইলে হয়তো দোষ হইতে মুক্ত থাকিতে পারিতেন। নিউটন যদি স্বাস্থ্যবান হইতেন এবং জীবনের সাধারণ সুখ উপভোগ করিতে পারিতেন তবে হয়তো লিবিনিজের [Leibiniz] সঙ্গে তাহার যে বাকবিতণ্ডার ফলে ইংল্যাণ্ডের গণিতবিদ্যা একশত বৎসরের জন্য ধ্বংস হইয়াছিল তাহা সংগঠিতই হইত না। দৈহিক পূর্ণস্বাস্থ্যের কিছু কিছু দোষ থাকা সত্ত্বেও উদ্যমকে আমি মানুষের পক্ষে একান্ত কাম্য গুণ বলিয়া মনে করি।