আমেরিকার পাবলিক স্কুল সাফল্যের সঙ্গে যে কাজ সম্পন্ন করিয়াছে তাহা পূর্বে কোথাও বিরাট আকারে করার চেষ্টা করা হয় নাই। ইহা বিভিন্ন জাতির কতক মানবগোষ্ঠীকে এক মহান জাতিতে পরিণত করা। আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপের নানা জাতির লোক এখানে উপনিবেশ স্থাপন করিতে আসে। নানা ভাষা, নানা জাতি, নানারূপ জাতীয় বৈশিষ্ট্য; ইহা সত্ত্বেও এই সকল লোকগোষ্ঠীকে এমন সুষ্ঠুভাবে এক জাতিতে পরিণত করা হইয়াছে যে, যাহারা ইহা করিয়াছেন তাহাদের কৃতিত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিতে হয়। কিন্তু জাপানের মতো আমেরিকার অবস্থাও স্বতন্ত্র, কাজেই অস্বাভাবিক অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করার ফলে কোনো নীতি কার্যকরি হইয়াছে বলিয়াই তাহা যে সর্বত্র সুফলপ্রদ এবং উপযোগী হইবে এমন কোনো কথা নাই। আমেরিকার কতকগুলি সুবিধা আছে, অসুবিধাও আছে। সুবিধাগুলি হইল ও অর্থের প্রাচুর্য, যুদ্ধে পরাজয় আশঙ্কা না থাকা, মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের হাত হইতে অব্যাহতি। বিভিন্ন দেশ হইতে উপনিবেশ স্থাপন করিতে যাহারা আসিয়াছিল তাহারা মার্কিন মুল্লুক জনসাধারণের মধ্যে গণতন্ত্রে অনুকূল মনোভাব এবং যান্ত্রিক সভ্যতার অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থা দেখিতে পায়, এই দুইটিই মনে হয় প্রধান কারণ যে জন্য প্রায় সকলেই নিজেদের জন্মভূমি অপেক্ষা আমেরিকার প্রশংসায় মুখর হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু নবাগত স্বদেশপ্রেম হইয়াছিল দ্বিমুখি: ইউরোপে যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে তাহারা ডিনজেদের আসল জন্মভূমির সমর্থক হইয়া পড়িত। পক্ষান্তরে তাহাদের সন্তানসন্ততির তাহাদের পূর্বপুরুষের মাতৃভূমির প্রতি কোনো দরদ নাই, তাহারা আমেরিকার অধিবাসীরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ইহাদের পিতামাতার যে মনোভাব তাহা মার্কিন মুলুকের সাধারণ গুণের ফলেই সম্ভব হইয়াছে; সন্তানসন্ততিবর্গের মনোভাব গড়িয়া তুলিয়াছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার ফলে কি হইয়াছে তাহাই আমাদের বিবেচনার বিষয়।
মার্কিন দেশের যে সব গুণ আছে তাহা শিক্ষার ভিতর দিয়া নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হইয়াছে। এক্ষেত্রে স্বদেশ ও প্রেমকে কোনো ভ্রান্ত আদর্শের সঙ্গে জড়িত করিয়া শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয় নাই। কিন্তু যেখানে প্রাচীন মহাদেশ ইউরোপ নূতন মহাদেশ আমেরিকা হইতে শ্রেষ্ঠ, সেখানে প্রকৃত ভালো জিনিসের প্রতিও অবজ্ঞার ভাব ছাত্রদের মনে গড়িয়া তোলা হয়। পশ্চিম ইউরোপে জ্ঞান ও শিক্ষার মান এবং পূর্ব ইউরোপের শিল্পের মান মোটের উপর আমেরিকার মান অপেক্ষা উচ্চ। স্পেন ও পর্তুগাল ছাড়া সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে ধর্ম সম্বন্ধীয় কুসংস্কার মার্কিন দেশ অপেক্ষা অনেক কম। ইউরোপের প্রায় সকল দেশেই ব্যক্তির উপর গোষ্ঠীর প্রভাব যেমন, মার্কিন দেশে তেমন বেশি নয়; এমনকি যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কম সেখানেও তাহার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা অনেক বেশি। এই বিষয়ে মার্কিন পাবলিক স্কুলগুলি বিশেষ ক্ষতিসাধন করে। অন্য সব কিছু বাদ দিয়া কেবল মার্কিনি স্বদেশপ্রেম শিক্ষা দেওয়াতেই ইহার উদ্ভব। জাপানি এবং জেসুইটদের মতোই এই অপকারের আসল কারণ হইল ছাত্রদের মঙ্গলের জন্যই তাহাদের শিক্ষা না দিয়া কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায়স্বরূপ তাহাদিগকে গড়িয়া তোলা। শিক্ষক তাঁহার রাষ্ট্র কিংবা ধর্মপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে ছাত্রকে বেশি ভালোবাসিবেন; তাহা না হইলে তিনি আদর্শ শিক্ষকই নহেন।
আমরা যদি বলি ছাত্র অর্থাৎ ছাত্রের কল্যাণই শিক্ষার চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত, ছাত্রকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায়রূপে ব্যবহার শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় তবে কেহ প্রত্যুত্তরে বলিতে পারেন কোনো উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই প্রত্যেকের প্রয়োজন, নতুবা তাহার সার্থকতা কি? একজন মানুষই যদি লক্ষ্য হয়, তবে তাহার মৃত্যুর সঙ্গেই সব লোপ পাইল কিন্তু উপায়স্বরূপ হইয়া সে যাহা কিছু উৎপন্ন করে তাহা তো টিকিয়া থাকে। এ তর্ক আমরা অস্বীকার করিতে পারি না। উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হিসাবে একজন মানুষ ভালো কাজে বা মন্দ কাজে লাগিতে পারে। মানুষের কাজের বহুদূরপ্রসারী শেষফল এত অনিশ্চিত যে, বিজ্ঞ লোকমাত্রই তাহা লইয়া মাথা ঘামাইতে চাহিবেন না। মোটামুটি বলিতে গেলে ভালো লোকের কাজ ভাল, খারাপ লোকের কাজ খারাপ, তবে ইহাও অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম নহে। একজন খারাপ লোক একজন অত্যাচারীকে হত্যা করিতে পারে; কারণ সে হয়তো এমন অপরাধ করিয়াছে যেজন্য অত্যাচারী শাসক তাহাকে শাস্তি দিতে চায়। যদিও সে নিজে এবং তাহার কাজ ভাল নয় তথাপি তাহার কাজের ফল ভালো হইতেও পারে। কিন্তু সাধারণ নিয়মে ইহাই দেখা যায় যে, যেখানে জনসাধারণ অজ্ঞ এবং অপকারী সেখানকার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট নরনারী সমন্বয়ে গঠিত মানব-সমাজে সুফল বেশি। ইহা ছাড়া কাহারা ছাত্রদের মঙ্গল কামনা করে, কাহারাই বা তাহাদিগকে কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায় বা কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে তাহা শিশু, কিশোর ও যুবকগণ সহজেই বুঝিতে পারে। শিক্ষক যদি ছাত্রের প্রতি মমতাহীন হন, তবে ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তি বা চরিত্র কোনোটিই সম্যক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে পারে না; একমাত্র শিশুর মঙ্গল কামনার মধ্যেই এরূপ মমতা নিহিত থাকে। আমাদের সকলেরই নিজের সম্বন্ধে এরূপ মমতা আছে; আমরা নিজের জন্য ভালো জিনিস কামনা করি কিন্তু ইহার দ্বারা যে কোন মহৎ কাজ সম্পন্ন হইবে এরূপ কোনো প্রমাণও আগে দেখিতে চাই না। প্রত্যেক স্নেহশীল জনক বা জননী তাহার সন্তানের জন্য এরূপই ভাবেন। তাহারা নিজেরা যেমন নিজেদের মঙ্গল কামনা করেন, তেমনি চান তাহাদের সন্তান সবল এবং স্বাস্থ্যবান হইয়া গড়িয়া উঠুক, স্কুলে পড়াশুনায়। ভালো করুক ইত্যাদি; কাম্য অবস্থা বা জিনিস শেষ পর্যন্ত ভালো কি মন্দ ফল দিবে, ইহার দ্বারা ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষিত হইবে কিনা কেহ এসব চুলচেরা বিচার করিয়া দেখে না। জনক-জননীর হৃদয়ে যে সন্তানের জন্য স্বাভাবিক মঙ্গল কামনা রহিয়াছে তাহা সর্বদা কেবল নিজের সন্তানের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকে না। শিশুদের শিক্ষক যিনি হইবেন তাঁহার অন্তরে এই কামনা থাকা চাই। শিশুদের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইহা কতকটা শিথিল হইয়া আসে। কিন্তু যাহারা শিশুদের প্রতি মমতা এবং তাদের কল্যাণচিন্তা পোষণ করেন কেবল তাহারাই শিক্ষাপ্রণালী রচনার অধিকারী হইতে পারেন। যাহারা মনে করেন যুদ্ধ করিতে এবং যুদ্ধে প্রাণ দিতে ইচ্ছুক ও সক্ষম পুরুষ তৈয়ার করাই বালকদের শিক্ষার উদ্দেশ্য তাঁহাদের মনে পিতৃহৃদয়ের মমতা নাই; তথাপি এইরূপ লোকই ডেনমার্ক এবং চীনদেশ ছাড়া সর্বত্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করিতেছেন।