এইভাবে দেখা যাইতেছে যে, প্রাচীন চীনে যে ত্রুটি ছিল আধুনিক জাপানে ঠিক তাহার বিপরীত ত্রুটি রহিয়াছে। চীনের শিক্ষাভিমানী ব্যক্তিরা ছিলেন অবিশ্বাসী এবং অলস; শিক্ষিত জাপানিরা নিজেদের অভিমতকে একেবারে অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস করে, কাজেও তাহাদের আদম্য উৎসাহে। সব কিছু সম্বন্ধেই অবিশ্বাসের ভাব পোষণ করা কিংবা সব কিছুতেই নিজের মত অভ্রান্ত বলিয়া মনে করা–ইহার কোনোটিই প্রকৃত শিক্ষার ফল হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। শিক্ষাকে এইরূপ বিশ্বাস উৎপাদন করিতে হইবে যে, কষ্টকর হইলেই কিছু পরিমাণ জ্ঞান অর্জন সম্ভবপর; এক সময় যাহা জ্ঞান বলিয়া মনে করা হয় অন্য সময় তাহা হয়তো কিছুটা ভুল হইতে পারে, কিন্তু ওই ভুল যত্ন ও পরিশ্রম দ্বারা সংশোধন করা যায়। যেখানে সামান্য একটু ভুলের ফলে বিপদ ঘটিতে পারে সেখানে। বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়াই আমাদিগকে কাজ করিতে হইবে। মনের এইরূপ অবস্থাপ্রাপ্তি কঠিন ব্যাপার; ইহার জন্য চাই ভাবাবেগ এবং উচ্চস্তরের বুদ্ধি প্রয়োগ! কঠিন হইলেও ইহা অসম্ভব নয়; কার্যত ইহাই বৈজ্ঞানিক স্বভাব বা মেজাজ। অন্যান্য ভালো জিনিসের মতোই জ্ঞানলাভ কঠিন; কিন্তু অসম্ভব নয়। অভ্রান্তবাদীরা ইহা মোটেই কঠিন মনে করে না, অবিশ্বাসীরা ইহার, সম্ভাব্যতাই বিশ্বাস করে না। এই দুই পক্ষই ভ্রান্ত; ইহাদের ভুল ব্যাপক হইলেই শুরু হয় সামাজিক বিপদাপদ।
আধুনিক জাপানিদের মতো জেসুইটগণও শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের জন্য নিয়োজিত করিয়া ভুল করিয়াছিলেন। তাঁহাদের এই প্রতিষ্ঠান ছিল ক্যাথলিক ধর্মসংঘ। তাহারা কোনো ছাত্রের ব্যক্তিগত কল্যাণ কামনা করিতেন না; ধর্মসংঘের প্রয়োজনে লাগে এমনভাবে তাহাকে গড়িয়া তোলাই ছিল তাঁহাদের উদ্দেশ্য। আমরা যদি তাঁহাদের মতবাদ গ্রহণ করি তবে তাহাদিগকে দোষ দিতে পারি না। তাহাদের ধর্মনীতি হইল–নরক হইতে একটি আত্মাকে উদ্ধার করা যে কোনো জাগতিক কাজ হতে শ্রেষ্ঠ এবং এই কাজ কেবল ক্যাথলিক ধর্মসংঘই করিতে পারে। যাহারা জেসুইটদের এই মতবাদ মানেন না, তাহারা ফলাফল দেখিয়া জেসুইট শিক্ষার বিচার করিবেন। এই শিক্ষার ফলে অনেক সময় Uriah Heep-এর মতো অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তৈয়ারি হইয়াছে। ভল্টেয়ারও জেসুইট শিক্ষার ফলস্বরূপ। মোটের উপর অনেক কাল ধরিয়া জেসুইট শিক্ষার ফল পাওয়া গিয়াছিল। বিরুদ্ধ সংস্কার আন্দোলন (Counter Reformation] এবং ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের বিলোপ জেসুইটদের শিক্ষার ফলেই সম্ভব হইয়াছিল। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁহারা শিল্পকে করিয়াছিলেন ভাবপ্রবণ, চিন্তাধারাকে করিয়াছিলেন ভাসা ভাসা, অগভীর এবং নীতিবোধকে করিয়াছিলেন শিথিল। অবশেষে তাঁহাদের এই কুফলের আবর্জনা ভাসাইয়া লইবার জন্য ফরাসিবিপ্লবের প্রয়োজন হইয়াছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে তাহাদের অপরাধ ছিল এই যে, ছাত্রের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা নয়, নিজেদের স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তাঁহারা পরিচালিত হইতেন।
ডক্টর আর্নল্ডের শিক্ষাপ্রণালী অদ্যাবধি ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলসমূহে প্রচলিত রহিয়াছে; ইহার একটি দোষ হইল যে ইহা আভিজাত্য গর্বে গর্বিত। এ শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল, কি স্বদেশের, কি সুদূর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক অংশে যাহারা উচ্চপদ ও ক্ষমতায় অধিকারী হইবেন এমন লোক তৈয়ার করা। অভিজাত সম্প্রদায়কে টিকিয়া থাকিতে হইলে কতকগুলি গুণের বিকাশ ঘটাইতে হয়; এইগুলি স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হইত। ফলে গড়িয়া উঠিল উদ্যমশীল, দৈহিক এবং নৈতিক শক্তিতে শক্তিমান, ধৈর্যশীল এবং অভিজাত সম্প্রদায়। তাহাদের মনে এমন এক ধারণা বদ্ধমূল হইল যে, তাহারা যাহা জানে তাহাই সত্য, তাহার কোনো পরিবর্তণ হইতে পারে না এবং তাহারা বিশ্বে কোনো মহৎ কার্য সম্পাদন করিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে! বিস্ময়করভাবে এই ফল ফলিয়াছিল। ইহার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকে বিসর্জন দিতে হইয়াছিল, কেননা বুদ্ধি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি করিতে পারে; তথাকথিত নিকৃষ্ট শ্রেণির বা জাতির লোকদের উপর শাসন করিতে গেলে সহানুভূতি প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিতে পারে। কাজেই সহানুভূতি বিসর্জন দেওয়া হইল, দ্র আচরণের পরিবর্তে দৃঢ়তার উপর জোর দেওয়া হইল। ইহাই হইল এ অভিজাত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য। জগৎ যদি পরিবর্তনশীল হইত তবে ব্রিটিশ অভিজাত সম্প্রদায়ে স্পাটার্নদের দোষগুণের অধিকারী হইয়া স্থায়িত্ব লাভ করিত। কিন্তু আভিজাত্যের দিন চলিয়া গিয়াছে, কোনো শাসিত জাতিই বিজ্ঞ এবং গুণশালী শাসককেও আর মানিতে চাহিবে না। ইহার ফলে শাসকগণ অত্যাচারী হইয়া ওঠেন; অত্যাচার বিদ্রোহের পথই সুগম করিয়া দেয়। বর্তমান বিশ্বের জটিল সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য ক্রমেই বেশি পরিমাণে বুদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু ডক্টর আর্নল্ড বুদ্ধিবৃত্তি বিসর্জন দিয়া তাহার ছাত্রদের মধ্যে কতকগুলি গুণের বিকাশ ঘটাইয়াছিলেন। ইটনের খেলার মাঠে যুদ্ধ জয় সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হারানোর সূচনাও হইয়াছিল ওইখানেই। বর্তমানে জগৎ অন্য ধরনের লোক চায়; এখন দরকার উদার কল্পনা ও সহানুভূতি, দরকার বুদ্ধিশক্তির নমনীয়তা; বুলডগের মতো একগুঁয়ে সাহসের পরিবর্তে যন্ত্র বিজ্ঞানের উপর বেশি আস্থার প্রয়োজন। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপরিচালককে স্বাধীন নাগরিকের সেবক হইতে হইবে, প্রশংসমান প্রজাবৃন্দের শাসক হইলে চলিবে না। ব্রিটিশ উচ্চশিক্ষার মধ্যে যে আভিজাত্যের ধারা বদ্ধমূল রহিয়াছে তাহাই হইয়াছে ইহার ধ্বংসের কারণ। হয়তো এই ঐতিহ্য ক্রমে ক্রমে দূর করা সম্ভব; হয়তো বা প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমানের প্রয়োজনের সঙ্গে নিজদিগকে খাপ খাওয়াইতে পারিবে না। এ সম্বন্ধে আমি কোনো অভিমত দিতে চাই না।