- বইয়ের নামঃ শিক্ষা প্রসঙ্গ
- লেখকের নামঃ বার্ট্রান্ড রাসেল
- প্রকাশনাঃ শব্দগুচ্ছ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, প্রবন্ধ
শিক্ষা প্রসঙ্গ
০১. আধুনিক শিক্ষাতত্ত্ব
আগের দিনের লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক রচনা পাঠ করিলেও বোঝা যায় যে বর্তমানের শিক্ষাতত্ত্বের মধ্যে এমন কিছু নূতনত্ব আসিয়াছে যাহা পূর্বেকার প্রামাণিক গ্রন্থের মধ্যেও ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেকার দুইজন বড় শিক্ষা সংস্কারক লক্ [Locke] ও রুশো [Rousseau]। ইহারা উভয়েই খ্যাতির অধিকারী হইয়াছিলেন, কেননা তাহারা তকালে প্রচলিত শিক্ষা-সংক্রান্ত অনেক ভ্রম দূর করিয়াছিলেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদ যতদূর অগ্রসর হইয়াছেন, তাঁহাদের কেহই ততদূর যান নাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাহারা উভয়েই উদারতা ও গণতন্ত্রের পক্ষপাতী ছিলেন, তথাপি উভয়েই কেবল অভিজাত শিশুর শিক্ষাই বিবেচনা করিয়াছেন। তাঁহাদের পরিকল্পনায় একটি শিশুর শিক্ষার জন্য একজন বয়স্ক ব্যক্তি সর্বক্ষণ নিয়োজিত হইবে। ইহার ফল যতই উৎকৃষ্ট হোক না কেন, আধুনিক যুগের দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন কোনো লোকই এ পরিকল্পনা বিবেচনার যোগ্য মনে করিবেন না, কারণ এক-একটি শিশুর জন্য একজন করিয়া সর্বক্ষণস্থায়ী গৃহ-শিক্ষকের ব্যবস্থা করা গাণিতিক দিক দিয়া অসম্ভব। আধুনিক মানুষ নিজের ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধার খোঁজ করিতে পারে কিন্তু যে শিক্ষা-ব্যবস্থা সকলের জন্য উন্মুক্ত নয়, অনন্তপক্ষে যাহাদের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিলে তাহারা উপকৃত হইতে পারে এমন সকলের জন্যও উন্মুক্ত নয়–সে শিক্ষাপ্রণালীকে কেহ শিক্ষা বিস্তার সমস্যার সমাধান করিতে সক্ষম বলিয়া মনে করিবে না। অবশ্য এ কথা আমি বলি না যে, যে সুযোগ-সুবিধা সকলের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয় তাহা সচ্ছল লোকেরাও পরিহার করুক। ইহা করিলে ন্যায়ের কাছে সভ্যতাকে বিসর্জন দিতে হয়। আমি ইহাই বলিতে চাই যে, আমরা ভবিষ্যতের জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়িয়া তুলিব যাহা প্রত্যেকটি বালক-বালিকাকে আত্মবিকাশের জন্য পূর্ণ সুযোগ দান করিবে। আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হইতে হইবে, যদিও এ আদর্শ অবস্থা লাভ করা সময় সাপেক্ষ। বর্তমান যুগে এ ব্যবস্থা সকলেই স্বীকার করিবেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলিতে আমি ইহাই বুঝাইতেছি। আমি এমন ব্যবস্থাই সমর্থন করিব যাহা সর্বজনীন হইতে পারে, যদিও কেহ ব্যক্তিগতভাবে নিজের সন্তানসন্ততির জন্য অধিকতর সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিতে পারিলে আমার আপত্তি করার কোনো হেতু নাই। এইরূপ সঙ্কুচিত গণতান্ত্রিক প্রণালী লক্ ও রুশোর শিক্ষাবিষয়ক রচনাতে নাই। রুশো যদিও আভিজাত্যে বিশ্বাস করিতেন না, তাহার শিক্ষাপ্রণালীর মধ্যে কিন্তু এই বিশ্বাসহীনতার পরিচয় মেলে না।
গণতন্ত্র ও শিক্ষা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। গণতন্ত্র বলিতে যদি ইহাই বুঝায় যে সকলের জন্য একই স্তর সুনির্দিষ্ট থাকিবে, তবে তাহার ফল হইবে মারাত্মক। কতক বালক-বালিকার বুদ্ধি অপরের চেয়ে বেশি এবং তাহারা উচ্চ শিক্ষা হইতে অন্যের তুলনায় অধিকতর সুফল লাভ করিতে পারে। কতক শিক্ষক উৎকৃষ্টতর শিক্ষা লাভ করিয়াছেন, কাহারও-বা স্বাভাবিক শিক্ষাক্ষমতা অপরের চেয়ে বেশি। কিন্তু সকলের পক্ষেই উত্তম শিক্ষকের নিকট শিক্ষা লাভ করা অসম্ভব। সর্বোচ্চ শিক্ষাও সকলের জন্যই অপপ্রয়োগ করিয়া বলা চলে, যেহেতু উচ্চশিক্ষা লাভ সকলের পক্ষে সম্ভবপর নহে অতএব কাহাকেও ইহা দেওয়া উচিত নয়! এইরূপ নীতি গৃহীত হইলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি রুদ্ধ হইয়া যাইবে এবং শত বৎসরের জন্য শিক্ষার সাধারণ স্তর নিচে নামিয়া যাইবে। বর্তমান মুহূর্তে Mechanical equality-র বা যান্ত্রিক সমতার জন্য অগ্রগতি ব্যাহত করা উচিত হইবে না। সামাজিক অবিচারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকিলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবান সুফল ও সম্ভাব্যতা যথাসম্ভব কম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকতা আনয়ন করিতে হইবে। অত্যন্ত সতর্কতার সহিত এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক।
শিক্ষাব্যবস্থা যদি সর্বজনীন অর্থাৎ সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য না হয়। তবে তাহাকে সন্তোষজনক বলা চলে না। অর্থশালী লোকের ছেলেদের পরিচর্যার জন্য তাহাদের জননী ছাড়া ধাত্রী, পরিচারিকা ও অন্যান্য ভৃত্য থাকিতে পারে। কিন্তু যে কোনো রূপ সমাজব্যবস্থাতেই সকল ছেলেমেয়ের প্রতি এইরূপ যত্ন ও পরিচর্যার বিধান করা অসম্ভব। অতিরিক্ত আদর ও তত্ত্বাবধানের ফলে শিশুকে যে কোনো সামান্য কাজের জন্য পরমুখাপেক্ষী করিলে ইহার ফল ভাল হয় কি না সে বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ আছে। কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি ক্ষীণমনা [Feeble minded] কিংবা অসাধারণ প্রতিভাবান এই দুই শ্রেণির অস্বাভাবিক বালক বালিকা ছাড়া অন্যের জন্য এরূপ পরিচর্যার ব্যবস্থা অনুমোদন করিবেন না। বর্তমান যুগে বিজ্ঞ পিতা তাঁহার ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য সর্বজনীন নয় এমন কোনো শিক্ষণ-পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে অবলম্বন করিতে পারেন। এইরূপ পরীক্ষা সত্যই বাঞ্ছনীয়, তবে ইহা এরূপ হওয়া চাই যাহাতে সে-পদ্ধতি ফলপ্রদ হইলে যেন সকলের জন্য প্রয়োগ করা সম্ভবপর হয়; ইহা যেন কেবল অল্পসংখ্যক ভাগ্যবানের জন্যই সীমাবদ্ধ না রাখিতে হয়। সৌভাগ্যের কথা এই যে, বর্তমান যুগের শিক্ষাতত্ত্ব ও প্রণালীর কতক উৎকৃষ্ট উপাদান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হইতে পাওয়া গিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ম্যাডাম মন্তেসরি বস্তি অঞ্চলের শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাহার পরীক্ষামূলক কাজ আরম্ভ করিয়াছিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণ প্রতিভাবান ছাত্রের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করিতেই হইবে কিন্তু যেরূপ শিক্ষা সকল ছাত্রই গ্রহণ করিতে পারে, তাহা হইতে কাহাকেও বঞ্চিত করার কোনো সঙ্গত কারণ থাকিতে পারে না।