ডায়োনিসাস-পুরাণের অনেক রকম ভাষ্য আছে। সেগুলোর একটিতে বলা হয়, ডায়োনিসাস জিউস এবং পারসিফোনির পুত্র। যখন তিনি নিতান্ত বালক, তখন টাইটানরা তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছিল এবং শুধু তার হৃৎপিণ্ড ছাড়া সব মাংস খেয়ে ফেলেছিল। কেউ কেউ বলে সেই হৃৎপিণ্ড জিউস দিয়েছিলেন সিমিলিকে। অন্যরা বলে জিউস নিজেই তা গলাধঃকরণ করেন। এ দুয়ের যেটাই ঘটে থাকুক না কেন, তা থেকেই ডায়োনিসাসের দ্বিতীয় জন্ম ঘটে। মনে করা হয়, বাক্কাসের উপাসকরা বন্য পশুদের টুকরো টুকরো করে কেটে কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত টাইটানদের হাতে ডায়োনিসাসের টুকরো টুকরো হবার সেই ঘটনা উদযাপনের জন্য। এক অর্থে সেই বন্য পশুকে দেবতার প্রতিমূর্তি মনে করা হতো। টাইটানদের জন্ম পৃথিবীতে, কিন্তু দেবতাকে ভক্ষণ করার ফলে তাদের মধ্যে স্বর্গীয় দ্যুতি আসে। সে জন্যই মনে করা হতো মানুষ অংশত পার্থিব, অংশত স্বর্গীয় এবং বাক্কাসীয় কৃত্যানুষ্ঠানগুলোতে মানুষকে প্রায়-সম্পূর্ণরূপে স্বর্গীয় করে তোলার চেষ্টা চলত।
একজন অর্ফিক পুরোহিতের মুখ দিয়ে ইউরিপাইডিস একটি স্বীকারোক্তি উচ্চারণ করিয়েছেন, যা এ ব্যাপারে ইঙ্গিতবহ–
টায়ার বংশোদ্ভূত প্রভু ইউরোপার,
জিউস-জাত, পদতলে তোমার।
ক্রিটির শত নগরী,
সেই নিস্প্রভ সমাধি থেকে খুঁজছি তোমাকে।
সমাধির ছাদ বাঁকানো আর খোদাই-করা কড়ির,
শ্যালিব-ইস্পাত আর বুনো ষাঁড়ের শোণিতে
সাইপ্রেস কাঠের নিখুঁত জোড়ে সুদৃঢ়। এক বিশুদ্ধ স্রোতধারায়
আমার দিন গেল। সেবক আমি
ঈদীয় জোভের শাগরেদ,
যেখানে মধ্যরাতে বিহার করে জাগ্রেউস, বিহার করি আমি
আমি সয়েছি তার বজ্রচিৎকার;
পূর্ণ করে লোহিত রক্তাক্ত ভোজ
ধারণ করে মহামাতার পর্বতাগ্নি
আমি হয়েছি মুক্ত, অভিধা পেয়েছি
একজন বাক্কাস বর্মাচ্ছাদিত পুরোহিতদের।
শুভ্র বিশুদ্ধ পোশাকে নিজেকে করেছি অমল
মনুষ্যজন্মের কালিমা আর শবাধারের কাদা থেকে,
আর চিরতরে নির্বাসিত করেছি আমার ওষ্ঠ থেকে
সব মাংসের স্পর্শ, যেখানে জীবন ছিল।
বিভিন্ন সমাধিতে কিছু অফিক ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। পরজীবনে পথ খুঁজে পেতে হলে কী করতে হবে, নিজেকে পরিত্রাণের উপযুক্ত প্রমাণ করার জন্য কী বলতে হবে। ইত্যাদি সম্বন্ধে মৃত ব্যক্তির আত্মার উদ্দেশ্যে নির্দেশনা লেখা রয়েছে সেসব ফলকে। ফলকগুলো ভাঙা এবং অসম্পূর্ণ, সেগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি সম্পূর্ণ (প্যাটেলিয়া ফলক), তাতে এ রকম কথাবার্তা লেখা রয়েছে–
হাডেস ভবনের বাম পাশে তুমি একটি ঝরনা-কূপ দেখতে পাবে,
তার পার্শ্বে এক শ্বেত সাইপ্রাসবৃক্ষ দণ্ডায়মান।
ঝরনা-কূপটির নিকটবর্তী হয়ো না।
আরো একটি ঝরনা-কূপ দেখতে পাবে স্মৃতি হ্রদের পাশে,
সেখান থেকে শীতল পানি নির্গত হচ্ছে, তার সম্মুখে প্রহরীরা আছে।
তুমি বলো : মর্ত্য ও তারকাময় স্বর্গের এক সন্তান আমি;
কিন্তু আমার বংশ (শুধুই) স্বর্গের। তোমরা নিজেরাই তা জানো।
আর দেখো, তৃষ্ণায় আমি কাতর ও মৃত্যুপথযাত্রী। শিগগির আমাকে স্মৃতি-হ্রদ থেকে প্রবাহিত শীতল পানি এনে দাও।
তখন তারা নিজেরাই তোমাকে সেই পবিত্র ঝরনা-কূপ থেকে পানি পান করতে দেবে,
অতঃপর অপরাপর বীরদের মধ্যে তুমি কর্তৃত্ব লাভ করবে…।
অন্য একটি ফলকে লেখা রয়েছে : স্বাগতম, তোমরা যারা যন্ত্রণা সয়েছ…তোমরা মানুষের উর্ধ্বে উঠে দেবতা হয়েছ। আরো একটি ফুলকে বলা হচ্ছে : সুখী আর আশীর্বাদধন্যরা শোনো, তোমরা নশ্বর না হয়ে দেবতা হবে।
মৃতের আত্মাকে যে ঝরনা-কূপ থেকে পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছে সেটি লিথি (Lethe) বা বিস্মৃতি আনে। অন্য ঝরনা-কূপটি মেমোসাইনি (Mnemosyne), এর অর্থ স্মরণ বা স্মৃতি। পরলোকে আত্মাকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিস্মৃত হওয়া চলবে না, বরং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি স্মৃতিশক্তি অর্জন করতে হবে।
অর্ফিকরা ছিল এক আত্মনিরোধী, কৃছুবাদী গোষ্ঠী। মদ তাদের কাছে ছিল একটি প্রতীকমাত্র, যেমনটি পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় সংস্কারে হয়েছে। তারা যে মাদকতা কামনা করত তা ছিল উদ্দীপনার মাদকতা, ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের মাদকতা। তাদের বিশ্বাস ছিল সাধারণ উপায়ে যে মরমি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়, এই উপায়ে তা লাভ করা সম্ভব। গ্রিক দর্শনে এই মরমিবাদী উপাদান প্রবেশ করেছে পিথাগোরাসের হাত ধরে, যিনি ছিলেন অফিজিমের একজন সংস্কারক, যেমনটি অর্ফিয়ুস ছিলেন ডায়োনিসাসের ধর্মের একজন সংস্কারক। পিথাগোরাস থেকে অর্ফিক উপাদানগুলো প্রবেশ করেছে। প্লেটোর দর্শনে আর প্লেটো থেকে তা প্রবেশ করেছে পরবর্তীকালের যেসব দর্শন কিছু না কিছু মাত্রায় ধর্মীয় ছিল সেসবের অধিকাংশতে।
যেখানেই অফিজিমের প্রভাব ছিল সেখানেই বাক্কাসীয় উপাদানগুলো নিশ্চিতভাবে ছিল। সেগুলোর একটি ছিল নারীবাদ, পিথাগোরাসে নারীবাদের উপাদান ছিল যথেষ্ট পরিমাণে এবং প্লেটোতে নারীবাদ এত পরিমাণে ছিল যে তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সম্পূর্ণ সম-অধিকার দাবি করেছিলেন। পিথাগোরাস বলেন, লিঙ্গ হিসেবে নারী প্রকৃতিগতভাবে অধিকতর পবিত্র। বাক্কাসীয় উপাদানগুলোর আরেকটি ছিল তীব্র আবেগের প্রতি অনুরাগ। গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোর জন্ম হয়েছে ডায়োনিসাসের আচার অনুষ্ঠানাদি থেকে। বিশেষত, ইউরিপাইডিস অর্ফিজিমের দুই প্রধান দেবতাকে ভক্তি করতেন। তারা হলেন ডায়োনিসাস ও এবোস। শীতল, আপনভোলা, শান্ত স্বভাবী, সদাচারী ব্যক্তির জন্য তার কোনো শ্রদ্ধা ছিল না। তার ট্র্যাজেডিগুলোতে দেখা যায়, এই ধরনের চরিত্রগুলো পাগল হয়ে যায়, অথবা কোনো না কোনোভাবে অধর্মাচারের শাস্তি হিসেবে ঈশ্বর তাদেরকে দুঃখ-যন্ত্রণায় ফেলেন।