সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আসে নারীদের অধীনস্ত করার রীতি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি দাস শ্রেণির উৎপত্তি ঘটে। একদিকে সম্প্রদায়ের অভীষ্টগুলো ব্যক্তির ওপর আরোপিত হওয়ায়, অন্যদিকে নিজের জীবনকে পুরো সম্প্রদায়ের জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে দেখার অভ্যাস অর্জন করায় সে আরো বেশি করে তার বর্তমানকে ভবিষ্যতের জন্য উৎসর্গ করতে থাকে। এটা বেশ পরিষ্কার যে, এই প্রক্রিয়া অনেক দূর পর্যন্ত চলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একজন কঞ্জুস ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে। কিন্তু সে রকম চূড়ান্ত পর্যায়ে না গিয়েও দূরদর্শিতার কারণে জীবনের অনেক শ্রেষ্ঠ জিনিস হারাতে হতে পারে। ডায়োনিসাসের উপাসক দূরদর্শিতার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে। দূরদর্শিতা মানুষের অনুভূতির যে তীব্রতা নষ্ট করে দেয়, শারীরিক বা আধ্যাত্মিক নেশাগ্রস্ততার মধ্যে তা ফিরে পাওয়া যায়। নেশাগ্রস্ত হয়ে মানুষ জগৎকে আনন্দে আর সৌন্দর্যে ভরপুররূপে দেখতে পায় এবং প্রাত্যহিক চিন্তাকুলতার কারাগার থেকে তার কল্পনা হঠাৎ মুক্তি লাভ করে। যাকে উৎসাহ বা উদ্দীপনা বলা হতো, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পূজারি বা উপাসকের ভেতরে ঈশ্বরের প্রবিষ্ট হওয়া, বাক্কাসের আচার অনুষ্ঠানগুলো সেই উদ্দীপনা সৃষ্টি করত। ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে পেয়ে পূজারি মনে করত সে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। মানবসভ্যতার অর্জনগুলোর মধ্যে যেগুলো শ্রেষ্ঠ তার অধিকাংশের সঙ্গে নেশাগ্রস্ততার কিছু উপাদান জড়িত (আমি বলতে চাই, মানসিক নেশাগ্রস্ততা, অ্যালকোহল-সৃষ্ট নেশাগ্রস্ততা নয়), আবেগ দ্বারা নেশাগ্রস্ততাকে খানিকটা হটিয়ে দেওয়ার ব্যাপার আছে। বাক্কাসীয় উপাদান ছাড়া জীবন হয়ে পড়ত নিরানন্দ; আবার এইসব উপাদানপূর্ণ জীবন বিপজ্জনক। দূরদর্শিতা বনাম আবেগ-এমন একটি দ্বন্দ্ব যা ইতিহাসজুড়ে চলে আসছে। তবে এটা এমন কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নয়, যাতে আমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে কোনো একটি পক্ষ অবলম্বন করতেই হবে।
চিন্তার জগতে সংযমী বা মিতাচারী সভ্যতা মোটামুটি বিজ্ঞানের সমার্থক। কিন্তু নির্ভেজাল, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান মানুষকে পরিতুষ্ট করতে পারে না। মানুষের আবেগ, শিল্পকলা এবং ধর্মও প্রয়োজন। বিজ্ঞান জ্ঞানের সীমারেখা টেনে দিতে পারে, কিন্তু কল্পনার সীমা টানা বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। পরবর্তীকালের দার্শনিকদের কারো কারো মতো গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন প্রাথমিকভাবে বৈজ্ঞানিক, কেউ কেউ প্রাথমিকভাবে ধার্মিক। পরবর্তীরা, অর্থাৎ ধর্মপ্রবণ দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাক্কাসের ধর্মের কাছে বেশ ঋণী। এটা বিশেষভাবে প্লেটোর ক্ষেত্রে এবং তার মাধ্যমে সংঘটিত পরবর্তী বিকাশগুলো-যা শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে সঞ্চারিত হয়েছে-সেসবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ডায়োনিসাস-পূজার আদি রূপটি ছিল বর্বর এবং নানাভাবে বিকর্ষক ও বীভৎস। সেই আদি রূপ যে দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছিল তা নয়, বরং অর্ফিয়ুস কর্তৃক আরোপিত এর আধ্যাত্মিক রূপটির দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল আত্মনিরোধী, কৃচ্ছ্ববাদী এবং শারীরিক নেশাগ্রস্ততার পরিবর্তে মানসিক নেশাগ্রস্ততা। অর্ফিয়ুস একটি অনুজ্জ্বল কিন্তু আগ্রহব্যঞ্জক চরিত্র। কেউ কেউ মনে করেন তিনি একজন বাস্তব মানুষ ছিলেন, আবার কেউ কেউ মনে করেন তিনি ছিলেন একজন দেবতা, বা একজন কাল্পনিক বীর। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, তিনিও বাক্কাসের মতো থ্রেস থেকে আগত। কিন্তু তিনি (বা তার নামের সঙ্গে জড়িত ধারাটি) ক্রিটি দ্বীপের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অর্ফিক মতবাদগুলোর মধ্যে অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর প্রাথমিক উৎস মিসরীয় বলে মনে হয় এবং এটা নিশ্চিত যে, মিসর গ্রিসের ওপর প্রভাব ফেলেছিল প্রধানত ক্রিটির মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকে অর্ফিয়ুস ছিলেন একজন সংস্কারক, যাকে টুকরো টুকরো করে কেটেছিল বাক্কাসের গোড়া উপাসক মায়েনাড়রা। পৌরাণিক উপকথার প্রাচীন ভাষ্যগুলোতে সঙ্গীতের প্রতি অর্ফিয়ুসের আসক্তির কথা ততটা সুবিদিত ছিল না, যতটা হয়েছে পরবর্তীকালে। প্রাথমিকভাবে তিনি ছিলেন একজন পুরোহিত ও দার্শনিক। অর্ফিয়ুসের শিক্ষা (যদি আসলেই এ কথা সত্য হয় যে বাস্তবে তার। অস্তিত্ব ছিল) যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, অর্ফিয়ুসবাদীদের শিক্ষা কিন্তু বেশ পরিচিত। তারা ছিলেন আত্মার দেহান্তরে বিশ্বাসী। তারা এই শিক্ষা দিতেন যে, পৃথিবীতে মানুষের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে মৃত্যুর পর তার আত্মার অনাদি আনন্দ লাভ করতে পারে অথবা চিরন্তন বা সাময়িক নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তাদের লক্ষ্য ছিল বিশুদ্ধ বা পবিত্র হওয়া। সেটা তারা করার চেষ্টা করতেন অংশত শুদ্ধিকরণ কৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে, অংশত দূষণীয় কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করার মাধ্যমে। তাদের মধ্যে যারা ছিলেন সবচেয়ে কট্টর তারা কোনো প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করতেন না। তবে ধর্মীয় আচার ও সংস্কারবশত তারা তা খেতেন শুধু কিছু কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে। তারা মনে করতেন মানুষের কিছু অংশ পার্থিব আর কিছু অংশ স্বর্গীয়। শুদ্ধ জীবনযাপনের ফলে স্বর্গীয় অংশটি বৃদ্ধি পায় আর পার্থিব অংশটি লোপ পায়। এভাবে শুদ্ধ জীবনযাপন করতে করতে পরিশেষে একজন মানুষ বাক্কাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় এবং তখন তাকে একজন বাক্কাস বলে অভিহিত করা হয়। একটি বিশদ ধর্মতত্ত্ব ছিল, যা অনুসারে বাক্কাসের জন্ম হয়েছিল দুইবার। একবার তার মাতা সিমিলি থেকে, আরেকবার তার পিতা জিউসের ঊরু থেকে।