ধর্ম শব্দটি আমরা যেভাবে বুঝি তার অনেকটাই প্রাচীন গ্রিসে ছিল বলে মনে হয়। এটা অলিম্পীয়দের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল না, ছিল ডায়োনিসাস বা বাক্কাসের সঙ্গে। বাক্কাস বা ডায়োনিসাস সম্পর্কে আমাদের খুব স্বাভাবিক ধারণা যে, তিনি মদ এবং মাতলামির এক কুখ্যাত দেবতা। তার উপাসনা থেকে এক গভীর মরমিবাদের সৃষ্টি হয়েছে, সেই মরমিবাদ অনেক দার্শনিকের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে, এমনকি খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের রূপায়ণের মধ্যেও এর একটি অংশ রয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় এটা ঘটেছে তা বেশ লক্ষণীয় এবং যিনি গ্রিক চিন্তার বিকাশ অধ্যয়ন করার ইচ্ছা রাখেন তাকে অবশ্যই তা বুঝতে হবে।
ডায়োনিসাস বা বাক্কাস ছিলেন মূলত একজন গ্রেসীয় দেবতা। থ্রেসীয়রা গ্রিকদের চেয়ে অনেক কম সভ্য ছিল, গ্রিকরা তাদেরকে বর্বর মনে করত। সব আদিম কৃষিজীবীদের মতো গ্রেসীয়দেরও উর্বরতা-পূজা করার ধর্ম ছিল এবং তাদের একজন দেবতা ছিলেন যিনি উর্বরতা যোগাতেন। তার নাম ছিল বাক্কাস। বাক্কাসের আকার মানুষের মতো ছিল, না ষাঁড়ের মতো ছিল তা কখনোই জানা যায়নি। থ্রেসীয়রা যখন বিয়ার তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করে তখন তারা মাদকতাকে স্বর্গীয় ব্যাপার মনে করত এবং বাক্কাসকে ভক্তি করত। পরে, যখন তারা আঙুরলতার সঙ্গে পরিচিত হয় এবং মদপান শেখে, তখন বাক্কাসের প্রতি তারা আরো ভালো ধারণা পোষণ করতে থাকে। সাধারণভাবে উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য যে কাজ বাক্কাস করতেন সেটার চেয়ে আঙুর উৎপাদন আর মদ-সৃষ্ট স্বর্গীয় উন্মাদনা সৃষ্টির কাজ তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব লাভ করে।
বাক্কাস-পূজা কখন থ্রেস থেকে গ্রিসে চলে আসে তা জানা যায়নি। তবে মনে হয়, সেটা ঘটেছিল ঐতিহাসিক যুগ শুরু হবার ঠিক প্রাক্কালে। গ্রিসের গোড়া ধার্মিকরা বাক্কাস-পূজার প্রতি ছিল বিরূপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাক্কাস উপাসনায় অনেক বর্বর উপাদান ছিল। যেমন-বন্য পশুকে টুকরো টুকরো করে কেটে পুরোটাই কাঁচা খাওয়া হতো। বাক্কাস-পূজার মধ্যে নারীবাদের একটি কৌতূহলোদ্দীপক উপাদান ছিল। বয়স্কা মহিলারা এবং অবিবাহিত তরুণীরা বড় বড় দল বেঁধে উন্মুক্ত পাহাড়ে সারা রাত নৃত্য করত, এই নৃত্য তাদের মনে আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভের তীব্র অনুভূতি জাগাত। তাদের এই অনুভূতি ছিল প্রধানত আধ্যাত্মিক এবং অংশত মদপানজনিত। এই রীতি তাদের স্বামীদের অসন্তুষ্ট করত, কিন্তু তাদের স্বামীরা ধর্মের বিরোধিতা করার সাহস পেত না। ধর্মীয় উপাসনার এই রীতির সৌন্দর্য ও বর্বরতা বর্ণিত হয়েছে ইউরিপাইডিসের Bacchae শীর্ষক রচনায়।
গ্রিসে ডায়োনিসাস-পূজার সিদ্ধিতে অবাক হবার কিছু নেই। দ্রুত সভ্যতা অর্জনকারী সব সম্প্রদায়ের মতোই গ্রিকদের বা অন্তত তাদের কিছু অংশের মধ্যে আদিম-এর প্রতি একধরনের অনুরাগ গড়ে উঠেছিল। সমকালীন বা প্রচলিত নৈতিকতা দ্বারা বেঁধে-দেওয়া জীবনের চেয়ে তাদের বেশি ঝোঁক ছিল প্রবৃত্তিতাড়িত, প্রবল আবেগপ্রবণ জীবন-পদ্ধতির প্রতি। যে নারী বা যে পুরুষ অনুভূতির টানে নয়, নেহায়েত প্রচলিত আচার-ব্যবহারের দায়ে সভ্য হতে বাধ্য হয়েছে, তার কাছে যৌক্তিকতা বা বুদ্ধি-বিবেচনা বিরক্তিকর। সদগুণকে সে মনে করত একটি বোঝা, দাসত্ব। এ থেকে তার প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিই আমাদের আলোচনায় বিশেষ স্থান পাবে। তবে প্রথমে অনুভূতি ও আচরণের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অবশ্যই কিছু বলে নেওয়া প্রয়োজন।
অসভ্য মানুষ থেকে সভ্য মানুষকে যা পৃথক করে তা হলো মূলত পরিণামদর্শিতা বা দূরদর্শিতা, অথবা আরেকটু বিশদভাবে বললে, পূর্বচিন্তা। ভবিষ্যতের সুখ বা আনন্দের খাতিরে সে বর্তমানের কষ্ট সহ্য করতে রাজি, যদি সেই ভবিষ্যৎ-সুখ অনেক দূরবর্তীও হয়। এই অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে কৃষির অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী শীতকালে খাদ্য পাবার জন্য কোনো পশু বা বর্বর মানুষ বসন্তকালে কাজ করে না। শুধু মৌমাছির মধুসগ্রহ আর কাঠবিড়ালীদের বাদাম লুকিয়ে রাখার মতো খাঁটি প্রবৃত্তিগত কাজগুলোই এর ব্যতিক্রম। এসব ক্ষেত্রে কোনো পূর্বচিন্তা কাজ করে না। মানুষের ক্ষেত্রে কেবল সে রকম কাজের প্রতিই একটি প্রত্যক্ষ প্রণোদনা থাকে যে কাজ পরবর্তী সময়ে উপকারী বা ফলদায়ী প্রমাণিত হয়। সত্যিকারের পূর্বচিন্তা কেবল তখনই উদ্রেক হয় যখন একজন মানুষ প্রবৃত্তিগত প্রণোদনা ছাড়াই একটি কিছু করে, কারণ বুদ্ধি তাকে বলে দেয় যে ভবিষ্যতে কোনো একসময়ে এই কাজের কিছু সুফল সে পাবে। শিকারে কোনো পূর্বচিন্তার প্রয়োজন হয় না, কারণ তা আনন্দদায়ক। কিন্তু ভূমিকৰ্ষণ খাটুনির কাজ, স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনা থেকে তা করা যায় না।
সভ্যতা প্রণোদনাকে নিয়ন্ত্রণ করে কেবল পূর্বচিন্তার দ্বারাই নয়, যে পূর্বচিন্তা একধরনের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ। আইন, সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রণোদনা। সভ্যতা প্রণোদনার নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে বর্বরতা থেকেই, তবে সেই নিয়ন্ত্রণে প্রবৃত্তির ভূমিকা ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে, শৃঙ্খলা ও নিয়মের ভূমিকা বেড়েছে। কিছু কিছু কাজ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং সেগুলো সম্পাদনের দায়ে শাস্তির বিধান হয়েছে। আর কিছু কিছু কাজ আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিমূলক না হলেও দুষ্টকর্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যারা এসব দুষ্টকর্ম করে সমাজ তাদের ভালো বলে না, প্রত্যাখ্যান করে।