হোমারের মানুষ-বীরদেরও স্বভাব-আচরণ খুব একটি ভালো নয়। তাদের নেতৃস্থানীয় পরিবার হলো হাউস অব পেলোপস। কিন্তু সুখী পারিবারিক জীবনের একটি আদর্শ দাঁড় করাতে এ পরিবার সফল হয়নি।
এ বংশের এশীয় প্রতিষ্ঠাতা তানতাবোস তার কর্মজীবন শুরু করেন দেবতাদের বিরুদ্ধে এক সরাসরি আক্রমণের মধ্য দিয়ে। কেউ কেউ বলেন তিনি দেবতাদের নরমাংস খাইয়ে প্রতারিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তার পুত্র পেলোপসের মাংস দেবতাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। পেলোপস অলৌকিকভাবে প্রাণ ফিরে পেলে নিজের অকর্মটা সম্পন্ন করেন। তিনি পিসার রাজা অনৌমাওসের সঙ্গে রথচালনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন রাজার রথচালক মারটিলিসের পরোক্ষ সহায়তায়। পেলোপস মারটিলিসকে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে রথচালক মারটিলিস যদি তাকে সহায়তা করেন তাহলে তিনি তাকে পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু পেলোপস প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হবার পর মারটিলিসকে পুরস্কার না দিয়ে বরং সাগরে নিক্ষেপ করেন। এরপর এর অভিশাপ পুরুষান্তরে বর্ষিত হয় তার পুত্র আট্রেয়াস আর থায়েস্টেসের ওপর। গ্রিক ভাষায় সে অভিশাপের নাম ate, যার অর্থ অপরাধের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। থায়েস্টেস তার ভাইয়ের স্ত্রীকে প্ররোচিত করে পরিবারের ভাগ্য চুরি করতে সক্ষম হয়। সেই ভাগ্য হলো সেই বিখ্যাত সোনালি পশমের ভেড়া। আর আট্রেয়াস সে জন্য তার ভাইয়ের নির্বাসনের ব্যবস্থা পাকাঁপোক্ত করে, তারপর তার সঙ্গে মিটমাট করার অজুহাতে ফিরিয়ে আনে এবং তার নিজেরই ছেলেমেয়েদের মাংস তাকে খাওয়ায়। তারপর এই অভিশাপের উত্তরাধিকারী হয় আট্রেয়াসের পুত্র আগামেনন। আগামেনন এক ধর্মের পাঁঠা হরিণ হত্যা করে আরটেমিসকে প্রতারিত করে, দেবীকে তুষ্ট করার জন্য নিজের কন্যা এফিজেনিয়াকে বলি দেয় ও তার নৌবহরের জন্য ট্রয়ে যাওয়ার একটি নিরাপদ রাস্তা পেয়ে যায় এবং পরিশেষে তার অবিশ্বস্ত স্ত্রী ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও তার প্রেমিক আইগিস্থসের হাতে খুন হয়। আইগিস্থস থায়েস্টেসের একজন বেঁচে যাওয়া পুত্র। আগামেননের পুত্র অরেস্টেস পরিণামে পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয় তার মা ও মায়ের প্রেমিক আইগিসকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে।
পূর্ণাঙ্গ একটি অর্জন হিসেবে হোমার ছিলেন আয়োনিয়ার ফসল, অর্থাৎ হেলেনিক এশিয়া মাইনর ও তার পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলোর। হোমারের কবিতাগুলো বর্তমান রূপে স্থিতি লাভ করে খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে। গ্রিক বিজ্ঞান, দর্শন এবং গণিতও শুরু হয় ওই শতাব্দীতেই। একই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন অনেক ঘটনা ঘটছিল। কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, জরআস্তর (জরথুস্ত্র)-যদি তাদের অস্তিত্ব সত্য হয়ে থাকে-সম্ভবত এই শতাব্দীরই মানুষ ছিলেন। কেউ কেউ বলেন ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সম্রাট সাইরুস পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, আর সে শতাব্দীর শেষের দিকে আয়োনিয়ার গ্রিক নগরীগুলো, যাদেরকে পারসিকরা একটি সীমিত স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দিয়েছিল, তারা একটি অসফল বিদ্রোহ করে। দারিউস সেই বিদ্রোহ দমন করেন আর সেসব গ্রিক নগরীর সেরা সেরা লোকজন নির্বাসিত হয়। এই যুগের কয়েকজন দার্শনিক ছিলেন উদ্বাস্তু। হেলেনিক জগতের তখন পর্যন্ত মুক্ত এক নগরী থেকে অন্য নগরীতে তারা ঘুরে বেড়াতেন। আর তখন পর্যন্ত যে সংস্কৃতি আয়োনিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা তারা অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দেন। যেসব জায়গায় তারা ঘুরে বেড়াতেন সেখানে সদয় আচরণ পেতেন। জেনোফেন, যিনি খ্যাতি লাভ করেন ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে, তিনি ছিলেন উদ্বাস্তু দার্শনিকদের অন্যতম। তিনি বলেন, এটা এমন একটি ব্যাপার ছিল যাকে বলতে হয় শীতকালে আগুনের পাশে উত্তম খাদ্য গ্রহণের পর মিষ্টি সুরা পান করতে করতে নরম গদিতে শুয়ে হলুদ মটর দানা চিবানো : কোন দেশ থেকে এসেছেন, কত বয়স আপনার, জনাব? যখন মিডির আবির্ভাব ঘটেছিল, তখনই বা কত বয়স ছিল আপনার…? সালামিস আর প্লটেয়ার যুদ্ধে গ্রিসের অবশিষ্ট অংশ স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এ দুই যুদ্ধের পর আয়োনিয়া কিছু সময়ের জন্য মুক্ত হয়েছিল।
অনেক ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল গ্রিস। একটি করে নগরী আর সেটিকে ঘিরে কিছু কৃষি-অঞ্চল নিয়ে রাষ্ট্রগুলো গঠিত ছিল। গ্রিক দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে সভ্যতার স্তর খুবই ভিন্ন ভিন্ন রকমের ছিল। শুধু অল্পসংখ্যক নগরীই পুরো হেলেনিক সিদ্ধিতে অবদান রাখতে পেরেছিল। স্পার্টা, যার সম্পর্কে পরে আমার অনেক কিছু বলার থাকবে, গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামরিক দিক থেকে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে নয়। করিন্থ ছিল ধনী ও সমৃদ্ধিশালী। সেটা ছিল এক বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্র, কিন্তু বড় বড় ব্যক্তিত্বের মানুষ করিন্থে খুব বেশি ছিল না। তারপর ছিল খাঁটি কৃষিজীবী গ্রামীণ সম্প্রদায়, প্রবাদতুল্য আর্কেডিয়ার মতো নগরীর লোকেরা আর্কেডিয়াকে স্বপ্নসুখাচ্ছন্ন, শান্ত সমাহিত একটি স্থান বলে কল্পনা করত। কিন্তু আর্কেডিয়া আসলে ছিল প্রাচীন বর্বরতাপূর্ণ, বিভীষিকায় পরিপূর্ণ একটি জায়গা।
অধিবাসীরা হারমেস এবং পান-এর উপাসনা করত। তাদের মধ্যে উর্বরতা-পূজার অজস্র রকমফের ছিল। এসব উপাসনায় প্রায়ই একটি চৌকোনা খুঁটি দেবতার মূর্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কৃষকরা এত দরিদ্র ছিল যে তারা ষাড়ের মালিক হতে পারত না, তাই ছাগী ছিল তাদের কাছে উর্বরতার প্রতীক। যখন খাদ্যদ্রব্য খুব দুর্লভ হয়ে উঠত তখন পান-এর মূর্তিকে পেটানো হতো। (চীন দেশের কোনো কোনো প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে একই ধরনের রীতি এখনো প্রচলিত আছে।) কথিত ওয়্যার-উলফদের একটি পোত্র ছিল, যারা সম্ভবত নরবলি দিত এবং স্বজাতি মাংস ভক্ষণ করত। মনে করা হতো যে, কেউ যদি বলি-দেওয়া মানুষের মাংসের স্বাদ গ্রহণ করে তাহলে সে ওয়্যার-উলফ বনে যায়। নেকড়ে-জিউসের একটি পবিত্র গুহা ছিল; সে-গুহার ভেতরে কারোর ছায়া সৃষ্টি হতো না। আর যে সেই গুহায় প্রবেশ করত, এক বছরের মধ্যেই তার মৃত্যু হতো। ধ্রুপদী যুগেও এইসব কুসংস্কার সক্রিয়ভাবে প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ বলেন, দেবতা পান-এর প্রকৃত নাম ছিল পাওন (Paon)। শব্দটির অর্থ যে খাওয়ায় বা রাখাল। পারস্য যুদ্ধের পর খ্রি.পূ. পঞ্চম শতকে এথেন্সের লোকেরা যখন পান বা পাওনের উপাসনার রীতি গ্রহণ করে নেয়, তখন তার আরেকটি উপাধি অর্জিত হয়, যা আরো বেশি পরিচিত। সেটার ইংরেজি অর্থ দাঁড়ায় All-God, বাংলায় সর্বেশ্বর।