হেলেনিক সভ্যতার প্রথম উল্লেখযোগ্য ফসল ছিলেন হোমার। হোমার সম্পর্কে সবকিছুই অনুমাননির্ভর। তবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত একটি মত আছে যে, হোমার নামে কোনো একজন ব্যক্তি ছিল না, বরং এ নামে পরিচিত ছিলেন বেশ কয়েকজন কবি, আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। যারা এই ধারণায় বিশ্বাসী তাদের হিসেবে ইলিয়াড এবং অডেসি রচনা সম্পূর্ণ হবার মাঝখানের সময়গত দূরত্ব দুই শত বছর। কেউ কেউ বলেন খ্রি.পূ. ৭৫০ থেকে খ্রি.পূ. ৫৫০ সাল পর্যন্ত আবার অন্য অনেকে মনে করেন, অষ্টম শতকের শেষ নাগাদ হোমার প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছিল। হোমারীয় কবিতাগুলো বর্তমান রূপে এথেন্সে এনেছিলেন পেইসিস্ট্রাটাস। পেইসিস্ট্রাটাস গ্রিসে রাজত্ব করেন ৫৬০ খ্রি.পূ. থেকে ৫২৭ খ্রি.পূ. পর্যন্ত (মাঝখানে কিছু সময় বিরতিসহ)। তার সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে এথেনীয় যুবসম্প্রদায় হোমারের রচনা মুখস্থ করত এবং তা ছিল তাদের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্রিসের কিছু কিছু অংশে, বিশেষভাবে স্পার্টায়, আরো কিছুকাল অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত হোমারের মর্যাদা একই রকম ছিল না।
পরবর্তী-মধ্যযুগের প্রণয়-প্রার্থনা ধরনের রোম্যান্সগুলোর মতো হোমারীয় কবিতাগুলোতে একটি সভ্য অভিজাত শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারকে নিচ ও ইতর ভেবে উপেক্ষা করা হয়। এই কুসংস্কারগুলো এখনো জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে। অনেককাল পরে এগুলোর কিছু কিছু আবার বেরিয়ে এসেছে। নৃবিজ্ঞানের সহায়তায় অনেক বিজ্ঞানী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, হোমার সেকেলে ছিলেন না, ছিলেন একজন সংস্কারক বা সংশোধনকারী, প্রাচীন পুরাণগুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যাদানকারী অষ্টাদশ শতকের র্যাশনালাইজারদের মতো। অলিম্পীয় দেবতারা-যারা ছিলেন হোমারের মধ্যে ধর্মের প্রতিফলন-হোমারের যুগে বা তার পরের যুগেও শুধু গ্রিকদের মধ্যেই পূজনীয় ছিলেন না। গণধর্মের মধ্যে অন্য অনেক অন্ধকার ও অসভ্য উপাদান ছিল। সেগুলো গ্রিক মনীষা দ্বারা কোণঠাসা হয়ে থাকত, কিন্তু দুর্বলতা বা আতঙ্কের মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওঁৎ পেতে থাকত। হোমার যেসব বিশ্বাসকে বাতিল করে দিয়েছিলেন, অবক্ষয়ের যুগে সেগুলো টিকে ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে, ধ্রুপদী যুগ জুড়ে সেগুলো আধা বিলুপ্তির অবস্থায় ছিল। এই তথ্য অনেক বিষয়েরই ব্যাখ্যা হাজির করে, অন্যভাবে যা সঙ্গতিহীন বা বিস্ময়কর মনে হতে পারে। আদি ধর্মগুলো কোথাও ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, ছিল গোত্রীয় ব্যাপার। গোত্র বা উপজাতির মঙ্গলার্থগুলোকে এগিয়ে নেবার জন্য চিত্তাকর্ষক নানা ধরনের জাদুবিদ্যা দ্বারা কিছু বিশেষ কৃত্যানুষ্ঠান চলত। বিশেষভাবে উর্বরতা, গাছপালা, পশু ও মানুষের কল্যাণের জন্য এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হতো। দক্ষিণায়নের দিন সূর্যের শক্তি যাতে ফুরিয়ে না যায় সে জন্য সূর্যকে সাহস যোগানো হতো। বসন্ত আর ফসল কাটার ঋতুতেও যথাযথ অনুষ্ঠান করা হতো। এগুলো প্রায়ই এমন ছিল যাতে ব্যাপক সমষ্টিগত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যে উত্তেজনার মধ্যে ব্যক্তি-মানুষ তার বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে মুক্তি পায় এবং নিজেকে তার পুরো গোত্রের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। পৃথিবীজুড়েই ধর্মীয় বিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট ধাপে পৌঁছে পবিত্র পশু আর মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যা করা বা বলি দেওয়া হতো এবং তাদের ভক্ষণ করা হতো। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এই ধাপ এসেছিল বিভিন্ন সময়ে। বলি দেওয়া মানুষের মাংস ভক্ষণের চেয়ে বেশি দিন স্থায়ী ছিল নরবলির ধর্মীয় রীতি। ঐতিহাসিক যুগ শুরুর দিকেও গ্রিসে তা বিলুপ্ত হয়নি। এরূপ নির্দিষ্ট দিক বাদ দিয়ে উর্বরতা-প্রার্থনার কৃত্যানুষ্ঠানগুলো গ্রিসে ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। নির্দিষ্টভাবে এলিউসীয় গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানগুলো তাদের প্রতীকধর্মিতার দিক থেকে মূলত ছিল কৃষিভিত্তিক।
স্বীকার করতেই হবে, হোমারের মধ্যে ধর্ম ব্যাপারটা খুব একটি ধার্মিকতাপূর্ণ নয়। তার রচনায় দেবতারা আগাগোড়াই মানবসুলভ। মানুষের সঙ্গে দেবতাদের পার্থক্য শুধু এই যে, দেবতারা অমর এবং অতিমানবিক নানা ক্ষমতার অধিকারী। নৈতিক দিক থেকে এ ব্যাপারে কিছুই বলার নেই। তারা যে কীভাবে এতটা সম্ভ্রম বা ভয় উদ্রেক করতে পারত তা বোঝা কঠিন। হোমারের কাব্যগুলোর কোনো কোনো অংশে-যেগুলো মনে হয় পরের দিকে রচিত-দেবতাদেরকে ভলতেরীয় অশ্রদ্ধার সঙ্গে দেখানো হয়েছে। সেই অর্থে খাঁটি ধর্মীয় অনুভূতি হোমারে পাওয়া যায় না। ধর্মীয় অনুভূতি যা তার মধ্যে খেয়াল করা যায়, তা অলিম্পিয়াসের দেবতাদের চেয়ে নিয়তি, প্রয়োজন, পরিণতি-এ রকম সব অস্পষ্ট ছায়াময় বিষয়ের সঙ্গেই বেশি সম্পর্কিত। এমনকি হোমারের রচনায় বর্ণিত জিউসও এই বিষয়গুলোর অধীন ছিলেন। পুরো গ্রিক চিন্তায় নিয়তি বা ভাগ্যের একটি বড় প্রভাব ছিল এবং এটা সম্ভবত বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক নিয়মগুলোর প্রতি বিশ্বাসের উৎসগুলোর অন্যতম।
হোমারের দেবতারা ছিল একটি বিজয়ী অভিজাত সম্প্রদায়ের দেবতা। যারা বস্তুত ভূমি চাষ করত। ওইসব দেবতা তাদের উর্বরতার দেবতা ছিল না। গিলবার্ট মুরে যেমনটি বলেন: অধিকাংশ জাতির দেবতারা দাবি করে যে তারা বিশ্ব সৃষ্টি করেছে। অলিম্পীয় দেবতারা এ রকম দাবি করে না। তারা যা করেছে তা হলো বিশ্বকে জয় করা…আর যখন তাদের রাজ্যজয় সম্পন্ন হয়ে গেছে তখন তারা কী করে? তারা কি দেশ শাসনে আছে? তারা কি কৃষিকাজ চালাচ্ছে? তারা কি বাণিজ্য ও শিল্প করছে? মোটেই না। কেন তাদেরকে কোনো সৎ কাজ করতে হবে? তারা রাজস্ব আয়ের ওপর জীবনযাপনকেই বেশি সহজ মনে করে, আর যারা রাজস্ব পরিশোধ করে না তাদের ওপর বজ্রপাত ঘটানোই তাদের কাছে অধিকতর সহজ কাজ। তারা একেকজন বিজয়ী গোষ্ঠীপতি, একেকজন রাজকীয় বোম্বেটে। তারা যুদ্ধ করে, আনন্দোৎসব করে, আনন্দ-ফুর্তি আর পানভোজনে দিন কাটায়। তারা ক্রীড়ামোদে গা ভাসায়, সঙ্গীত রচনা করে, তারা আকণ্ঠ পান করে আর সেই খোঁড়া কর্মকারের প্রতি অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে, যে তাদের খেদমতে নিয়োজিত। নিজেদের রাজাকে ছাড়া তারা কখনো আর কাউকে ভয় পায় না। শুধু প্রেমে আর যুদ্ধক্ষেত্রে ছাড়া তারা কখনো মিথ্যা বলে না।