সফিস্টদের ব্যাপারে প্রাচীন গ্রিসের জনসমাজে বেশ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হতো। শুধু যে সাধারণ নাগরিকরাই তাদের নিন্দার চোখে দেখত তাই নয়, প্লেটো এবং তার পরবর্তীকালের দার্শনিকরাও তা-ই করতেন। সফিস্টদের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা ছিল তাদের বিরুদ্ধে এই ঘৃণার কিছুটা কারণ, তবে এই কারণটা কতখানি ছিল তা এখন বলা অসম্ভব। পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে সত্যের সন্ধান করতে হলে নৈতিক বিবেচনাগুলোকে অগ্রাহ্য করতে হবে। কোনো সমাজে হিতকর বলে যা বিবেচিত, অনুসন্ধানের ফলে প্রাপ্ত সত্যটি তা-ই হবে কি না তা আমরা আগে থেকে জানি না। কোন বিতর্ক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে সেই চিন্তা না করেই সফিস্টরা তর্ক চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রায়ই তর্কগুলো গিয়ে ঠেকত সংশয়বাদে। অন্যতম। সফিস্ট গরজিয়াস মনে করতেন যে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। যদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থেকে থাকে তবে তা জ্ঞেয় না এবং এটা যদি নিশ্চিতও হয় যে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে এবং তা কোনো ব্যক্তি বুঝতে পারে, তথাপি ওই ব্যক্তি কখনো তা অন্যদের জানাতে বা বোঝাতে পারে না। আমরা জানি না গরজিয়াসের যুক্তিগুলো কী ছিল, কিন্তু আমি বেশ কল্পনা করতে পারি যে তার যুক্তিগুলোর এমন যৌক্তিক শক্তি ছিল যে তার বিপক্ষের লোকজন বাধ্য হতো হিতাহিতবিষয়ক প্রসঙ্গের আশ্রয় নিতে। প্লেটো সব সময়ই এমন সব দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে কথা বলতেন যেগুলো তার বিবেচনায় মানুষকে সদগুণাবলি অর্জনে সহায়তা করবে। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে সৎ ছিলেন এটা বলা যায় না, কারণ তিনি বিভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচার করতেন সেগুলোর সামাজিক প্রভাব-পরিণতির দ্বারা। এমনকি এই ক্ষেত্রেও তিনি সৎ ছিলেন না। তিনি ভান করতেন যে তিনি বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক মানদণ্ড ধরে ধরে যুক্তি উত্থাপন করছেন এবং বিচার করছেন। কিন্তু আসলে তিনি তার আলোচনাকে নিয়ে যেতেন একটি সদগুণাত্মক ফলাফলের দিকে। তিনি এই দোষটি ঢুকিয়েছিলেন দর্শনের মধ্যে, তার পর থেকেই দর্শনে এটা রয়ে গেছে। সম্ভবত সফিস্টদের প্রতি বৈরী মনোভাবের ফলেই তার রচিত সংলাপগুলোর বৈশিষ্ট এ রকম হয়েছে। প্লেটোর পর থেকে সব দার্শনিকের অন্যতম দোষ হচ্ছে এই যে, নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে তাদের সব অনুসন্ধান অগ্রসর হয় এমন কিছু উপসংহারের দিকে যা তাদের আগে থেকেই জানা থাকে।
মনে হয়, পঞ্চম শতকের শেষ পর্বে এথেন্সে কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা এমন সব রাজনৈতিক মতবাদ শিক্ষা দিতেন যেগুলো তাদের সমসাময়িকদের কাছে অনৈতিক বলে বিবেচিত হতো এবং যা বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক জাতিগুলোর কাছেও তাই মনে হতে পারে। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের প্রথম পুস্তকে থ্রেসিমেকাস বলেন, সবলের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো ন্যায়বিচার নেই, আইনগুলো তৈরি করা হয় শাসকদের নিজ সুবিধার্থে, ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নৈর্ব্যক্তিক কোনো মানদণ্ড নেই। প্লেটোর বর্ণনা অনুসারে, গরজিয়াস সংলাপে ক্যালিক্লিসও একই ধরনের মতবাদ পোষণ করতেন। তিনি বলেন, প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে সবলের আইন, তবে সবলকে নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে মানুষ কতকগুলো প্রতিষ্ঠান ও নৈতিক বিধান প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীনকালের তুলনায় বর্তমান যুগে অধিকতর স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে সেগুলোর ব্যাপারে যা-ই মনে করা হোক না কেন, সফিস্টদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তা ছিল না।
কালক্রমে সফিস্টদের মধ্যে যে পরিবর্তনই ঘটে থাকুক না কেন, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকজুড়ে এথেন্সে ধীর-বুদ্ধি ও অনড় শুদ্ধবাদী সারল্য থেকে একধরনের উত্তরণ ঘটে। ধীর-বুদ্ধিবাদী প্রবণতা ও ক্ষীয়মাণ ধর্মীয় গোঁড়ামির সঙ্গে ক্ষিপ্র-বুদ্ধি ও একধরনের নির্মম অসুয়াবাদের সংঘাতের ফলে একটি পরিবর্তন সূচিত হয়। ওই শতাব্দীর শুরুর দিকে আয়োনিয়ার বিভিন্ন নগরীতে পারস্যের ওপর এথেন্সের আধিপত্য দেখা যায় এবং খ্রি.পূ. ৪৯০ সালে ম্যারাথন নামক স্থানে এথেন্স যুদ্ধে জয়ী হয়। আর শতাব্দীর শেষ দিকে, ৪০৪ সালে স্পার্টার কাছে এথেন্সের পরাজয় ঘটে এবং ৩৯৯ সালে সক্রেটিসের প্রাণদণ্ড হয়। এরপর থেকে রাজনৈতিকভাবে এথেন্সের গুরুত্ব লুপ্ত হয় কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ওই নগরী নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে, যা কিনা খ্রিস্ট ধর্মের বিজয় পর্যন্ত অটুট ছিল।
প্লেটোকে এবং তার পরবর্তীকালে পুরো গ্রিক মনীষাকে বোঝার জন্য খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এথেন্সের ইতিহাসের কিছু অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পারস্য যুদ্ধে ম্যারাথনে বিরাট বিজয়ের কারণে ওই যুদ্ধজয়ের প্রধান কৃতিত্ব গিয়েছিল এথেন্সের হাতে। তার দশ বছর পর দ্বিতীয় যুদ্ধের সময়েও এথেনীয়রা নৌশক্তিতে ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু স্থলযুদ্ধে বিজয় ঘটেছিল প্রধানত স্পার্টানদের কল্যাণে, যারা হেলেনিক জগতের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্পার্টানরা চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে ছিল মফস্বলী ধরনের এবং পারসিকদের বিরুদ্ধাচরণ করা তারা থামিয়ে দেয় যখন তাদেরকে গ্রিসের ইউরোপীয় অংশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। এশীয় অঞ্চলগুলোর গ্রিকদের রক্ষা করা এবং পারসিকদের দখলকৃত দ্বীপগুলোকে মুক্ত করার কাজ বেশ সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছিল এথেন্সের দ্বারা। এথেন্স এক শীর্ষস্থানীয় নৌশক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং আয়োনীয় দ্বীপগুলোতে উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। মধ্যপন্থী গণতন্ত্রী ও মধ্যপন্থী সাম্রাজ্যবাদী পেরিক্লিসের নেতৃত্বে এথেন্স অগ্রগতি অর্জন করেছিল। পারস্যের সম্রাট ক্ষারভেস এথেন্সের যেসব মন্দির ধ্বংস করেছিলেন সেগুলো তিনি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন এবং আরো কিছু নতুন মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এথেন্সের বিরাট মহিমামণ্ডিত যেসব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায় সেগুলো নির্মিত হয়েছিল তারই উদ্যোগে। এথেন্সে নগরী খুব দ্রুত গতিতে সম্পদে ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আর এ রকম সময়ে যেমনটি স্বাভাবিকভাবে ঘটে থাকে, বিশেষত যখন বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে সম্পদ বৃদ্ধি ঘটে, তখন চিরাচরিত নৈতিকতা ও প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর বিলোপ ঘটতে থাকে।