গ্রিসের মূল ভূখণ্ড পাহাড়ি এবং এর ব্যাপক অঞ্চল অনুর্বর। অবশ্য অনেক উপত্যকা ছিল যেখান থেকে সহজেই সাগরে পৌঁছানো যেত। কিন্তু উপত্যকাগুলো পাহাড়-পর্বত দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তাতে করে স্থলপথে যোগাযোগ সহজ ছিল না। এসব উপত্যকায় ছোট ছোট জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। সাধারণত সমুদ্রের কাছাকাছি কোনো নগরকে কেন্দ্র করে তারা বসবাস করত। তাদের জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। এ রকম পরিবেশে এটা খুব স্বাভাবিক ছিল যে জনগোষ্ঠীগুলো সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে পেতে যখন এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, তাদের নিজেদের ভূখণ্ডের সম্পদে তাদের চাহিদা আর মেটে না, তখন তাদের অনেকেই সাগরের দিকে অগ্রসর হয়। মূল ভূখণ্ডের নগরগুলো প্রায়ই এমন সব স্থানে তাদের কলোনি স্থাপন করে যেখানে উপজীবিকা ছিল মূল ভূখণ্ডের চেয়ে সহজতর। এইভাবে ইতিহাসের একেবারে শুরুর যুগে এশিয়া মাইনর, সিসিলি ও ইতালির গ্রিকরা মূল ভূখণ্ডের গ্রিকদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল।
গ্রিসের বিভিন্ন অংশের সামাজিক ব্যবস্থাগুলো ছিল খুবই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। স্পার্টায় একটি ক্ষুদ্র অভিজাত সম্প্রদায় ছিল যারা জীবনযাপন করত অন্য জাতির দাসদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষি অঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল মূলত চাষী। তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজেদের জমি চাষাবাদ করত। কিন্তু যেখানে শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছিল সেসব অঞ্চলে স্বাধীন নাগরিকরা দাসদের কাজে খাঁটিয়ে ধনী হতে থাকে। পুরুষ দাসদের তারা খাটাত খনিতে আর নারী দাসদের খাটাত বস্ত্রশিল্পে। আয়োনিয়াতে এই দাসরা ছিল চারপাশের বর্বর জনগোষ্ঠী, যাদেরকে অধিকার করে নেওয়া হয় যুদ্ধে। সম্পদবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধাভাজন নারীদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। পরবর্তীকালে গ্রিক সমাজ জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যায়, অবশ্য স্পার্টায় ও লেসবস-এ ছাড়া।
গ্রিসের সব অঞ্চলের বিকাশের মধ্যে একটি বেশ সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। বিকাশ ঘটেছিল প্রথমে রাজতন্ত্র থেকে অভিজাততন্ত্রে, তারপর স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্র বদলাবদলি করে। মিসর ও ব্যাবিলনিয়ার রাজাদের মতো গ্রিসের রাজারা নিরঙ্কুশ বা অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল না। তাদের পরামর্শদাতা হিসেবে বয়োজ্যেষ্ঠদের একটি পরিষদ থাকত। রাজারা প্রচলিত নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করলে শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেত না। স্বৈরতন্ত্র বলতে অবধারিতভাবে মন্দ শাসন বোঝত না, তা ছিল কেবল একজন মানুষের শাসন যার ক্ষমতার দাবি উত্তরাধিকারভিত্তিক ছিল না। গণতন্ত্র বলতে বোঝাত সব নাগরিকের শাসন, তবে দাস-দাসী ও নারীদের নাগরিক বলে গণ্য করা হতো না। মেডিসির মতো প্রথম দিকের স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা লাভ করে ধনিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে ধনী সদস্য হিসেবে। প্রায়ই তাদের সম্পদের উৎস ছিল সোনা ও রুপার খনির মালিকানা। মুদ্রা প্রস্তুতকরণ শুরু হবার পর থেকে সোনা-রুপা আরো বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে। মুদ্রা তৈরির শিল্প প্রথম আসে আয়োনিয়ার পার্শ্ববর্তী লিডিয়া থেকে। এই শিল্প প্রথম আবিষ্কৃত হয় ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সামান্য আগে।
বাণিজ্য আর দস্যুবৃত্তির মধ্যে শুরুতে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। গ্রিকদের কাছে বাণিজ্য বা দস্যুবৃত্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলগুলোর একটি ছিল লেখার কৌশল অর্জন। যদিও মিসর ও ব্যাবিলনিয়ায় হাজার বছর ধরে লেখার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল এবং আয়োনিয়ার ক্রিটীয়দেরও একটি হস্তলিপি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল-যা এখন গ্রিক ভাষারই একটি ধরন বলে জানা গেছে-তবু গ্রিকরা সঠিক কোন সময় থেকে বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখার কৌশল অর্জন করেছিল তা জানা যায়নি। বর্ণমালার সাহায্যে লেখার কৌশলটা তারা শিখেছিল ফিনিসীয়দের কাছ থেকে। সিরিয়ার অন্যান্য অধিবাসীদের মতো ফিনিসীয়দের ওপরও মিসর এবং ব্যাবিলনিয়ার প্রভাব ছিল। আয়োনিয়া, ইতালি ও সিসিলিতে গ্রিক নগরীগুলোর উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত উপকূলীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে ফিনিসীয়দেরই প্রাধান্য ছিল সর্বাধিক। চতুর্দশ শতকেও ইখনাতনের (Ikhnaton) চিঠিপত্র লেখার সময় সিরীয়রা ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্মই ব্যবহার করত। কিন্তু টায়ার এর হিরাম (৯৬৯-৯৩৬ খ্রি.পূ.) ব্যবহার করত ফিনিসীয় বর্ণমালা, যার বিকাশ ঘটেছিল সম্ভবত মিসরীয় হস্তলিপি থেকেই। শুরুর দিকে মিসরীয়রা শুধু ছবির মাধ্যমে লিখত। ক্রমান্বয়ে ছবিগুলো সর্বজনীনতা লাভ করতে থাকে এবং সবার দ্বারা ব্যবহৃত হতে হতে রীতি লাভ করে এবং একেকটা ছবি একেকটা শব্দাংশ বোঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে (অঙ্কিত বস্তুর নামের প্রথম শব্দাংশ)। এভাবে অবশেষে একেকটা বর্ণ বা অক্ষর তৈরি হয়। অক্ষর তৈরির নিয়মটা ছিল এ রকম : A ছিল একজন Archer, যে একটি ব্যাঙ মেরেছিল। গ্রিকরা তাদের ভাষার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো করে বর্ণমালা পরিবর্তন করে নিয়েছিল। শব্দ তৈরিতে শুধু ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহারের বদলে গ্রিকরা তাতে স্বরবর্ণ যোগ করার গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনাটি সাধন করেছিল। লেখার এই সুবিধাজনক পদ্ধতি অর্জনের ফলে গ্রিক সভ্যতা যে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়েছিল এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।