যে একটি ভ্রান্তি পরবর্তী-প্রাচীন যুগের ও মধ্যযুগের সব চিন্তাকে দূষিত করেছিল, ডেমোক্রিটাস ছিলেন, অন্ততপক্ষে আমার মতে, ওই ভ্রান্তি থেকে মুক্ত গ্রিক দার্শনিকদের সর্বশেষ জন। এ পর্যন্ত আমরা যেসব দার্শনিক সম্পর্কে আলোচনা করেছি তারা সবাই বিশ্বজগৎকে বোঝার এক নিরাসক্ত প্রয়াসে লিপ্ত ছিলেন। বিশ্বজগৎকে বোঝা যতটা সহজ বলে তারা মনে করতেন, তত সহজ তা নয়; কিন্তু এই আশাবাদ ছাড়া তাদের পক্ষে জগৎকে বোঝার প্রয়াস শুরু করার সাহস অর্জন করাই সম্ভব ছিল না। প্রধানত, যেসব বিষয়ে তাদের প্রবণতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের যুগের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও সংস্কারগুলো ক্রিয়াশীল ছিল না সেসব বিষয়ে তাদের ঝোঁক ছিল নির্ভেজাল বৈজ্ঞানিক। কিন্তু তাদের প্রবণতা শুধুই বৈজ্ঞানিক ছিল না, তারা একই সঙ্গে ছিলেন কল্পনাপ্রবণ, প্রাণপ্রাচুর্যময় এবং দুঃসাহসিক অভিযানের আনন্দে ভরপুর। উল্কা, সূর্য/চন্দ্রগ্রহণ, মৎস্যকুল, ঘূর্ণিবাত্যা, ধর্ম, নৈতিকতা ইত্যাদি সমস্ত কিছুর প্রতিই ছিল তাদের আগ্রহ ও আকর্ষণ। সর্বভেদী মননের সঙ্গে তাদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটেছিল শিশুসুলভ উৎসাহের।
এই পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতুলনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে, কিন্তু এই সময়ের পর থেকেই অবক্ষয়ের বীজ রোপিত হয় এবং অতঃপর ক্রমে অবনতি ঘটতে থাকে। ডেমোক্রিটাসের পর থেকে এমনকি সর্বোত্তম দর্শনের মধ্যেও একটি বিপথগামিতা দেখা দেয়, আর তা হচ্ছে বিশ্বজগতের চেয়ে মানুষের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ। প্রথমে আসে সংশয়বাদ, যা নিয়ে আসেন সফিস্টরা। এর ফলে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টার চেয়ে কীভাবে আমরা জ্ঞান পেতে পারি-এই জিজ্ঞাসাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তারপর, সক্রেটিসের মাধ্যমে নীতিশাস্ত্র হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ; তারপর প্লেটো এসে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের জগৎকে খারিজ করে স্বনির্মিত শুদ্ধচিন্তার জগতের পক্ষ নেন। তারপর অ্যারিস্টটল এসে বলেন, বিজ্ঞানে মৌলিক ধারণা হচ্ছে উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাস। প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের মৌলিক প্রতিভা সত্ত্বেও তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এমন অনেক দোষ ছিল যা পরবর্তীকালে ভীষণ ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। তাদের যুগের পর থেকেই গ্রিক মনীষায় প্রাণশক্তির ক্ষয় এবং জনসমাজে ক্রিয়াশীল নানা কুসংস্কারের পুনঃপ্রকোপ খেয়াল করা যায়। আংশিকভাবে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে ক্যাথলিক ধর্মের বিজয়ের ফলে; কিন্তু রেনেসাঁর আগে পর্যন্ত দর্শনে আগের সেই প্রাণশক্তি ও স্বনির্ভরতা ফিরে আসেনি, যা ছিল সক্রেটিসের পূর্বসূরিদের বৈশিষ্ট্য।
১০. প্রোটাগোরাস
সক্রেটিস-পূর্ব দর্শনের যেসব ধারা সম্পর্কে আমরা আগের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করছিলাম, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তা একটি সংশয়বাদী আন্দোলনের মুখোমুখি হয়। সে-আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন সফিস্টদের নেতা প্রোটাগোরাস। শুরুতে সফিস্ট শব্দটির কোনো নেতিবাচক ব্যঞ্জনার্থ ছিল না : এ যুগে অধ্যাপক বলতে আমরা যা বুঝি সে যুগে সফিস্ট শব্দটির অর্থ ছিল তারই কাছাকাছি। একজন সফিস্ট ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি তরুণ-যুবকদের কতিপয় বিষয়ে শিক্ষাদানের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করতেন। যেসব বিষয়কে তখনকার সমাজে ব্যবহারিক, বাস্তব জীবনে দরকারি ও উপকারী মনে করা হতো সেগুলোই ছিল সফিস্টদের শিক্ষাদানের বিষয়। সে রকম শিক্ষাদানের কোনো সরকারি ব্যবস্থা সে যুগে ছিল না বলে সফিস্টরা শুধু তাদেরই শিক্ষা দিতেন যাদের নিজেদের বা তাদের পিতামাতাদের আর্থিক সঙ্গতি ছিল। ফলে সফিস্টদের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতি পক্ষপাত ছিল, যা ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশের দ্বারা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এথেন্স ও অন্য অনেক নগরীতে রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছিল, কিন্তু প্রাচীন অভিজাত পরিবারগুলোর অর্থ-সম্পদ প্রায় অক্ষত ছিল। আমাদের কাছে হেলেনিক সংস্কৃতি বলে যা প্রতিভাত হয় তা ছিল মূলত ওই ধনীদের সংস্কৃতি। তাদের শিক্ষা ছিল, অবকাশ ছিল, পর্যাপ্ত ভ্রমণের ফলে তাদের জাতীয় সংস্কারাদি দূর হয়েছিল এবং তত্ত্বালোচনায় তারা যে সময় অতিবাহিত করত তার ফলে তাদের বুদ্ধি শাণিত হয়েছিল। যে ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা হতো তা দাসপ্রথাকে স্পর্শ করেনি। আর দাসপ্রথার কল্যাণে ধনীদের সম্পদ ভোগের জন্য মুক্ত নাগরিকদের শোষণ-নিপীড়ন করার প্রয়োজন হতো না। অবশ্য অনেক নগরীর, বিশেষত এথেন্সের, দরিদ্রতর নাগরিকরা ধনীদের প্রতি দ্বিগুণ শত্রুমনোভাবাপন্ন ছিল, তাদের প্রতি তাদের হিংসা ছিল, তাদের ঐতিহ্যের প্রতি ছিল বিদ্বেষ। সাধারণত এবং প্রায়ই ন্যায্যত, মনে করা হতো যে ধনীরা পাপী, তারা প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসকে নষ্ট করছিল এবং সম্ভবত গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল। এভাবে এমনটা ঘটে যে, রাজনৈতিক গণতন্ত্র ছিল সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, আর সাংস্কৃতিক দিক থেকে যারা নব্যপন্থী ছিল তাদের রাজনৈতিক ঝোঁক ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। কিছু মাত্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে আধুনিক আমেরিকায়, যেখানে ট্যামমানি মূলত একটি ক্যাথলিক সংগঠন হিসেবে আলোকায়নের ধাক্কা সামলাতে প্রাচীন ধর্মতাত্ত্বিক ও নৈতিক অন্ধবিশ্বাসগুলো রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত। কিন্তু আমেরিকার আলোকপ্রাপ্তরা এথেন্সের আলোকপ্রাপ্তদের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল। কারণ তারা ধনিকতন্ত্রের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে মেলাতে পারেনি। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান শ্রেণি আছে যারা ধনিকতন্ত্র রক্ষার পক্ষে কাজ করছে। তারা হচ্ছে করপোরেশন আইনজীবী শ্রেণি। এথেন্সের সফিস্টরা যা করেছিলেন, কিছু দিক থেকে আমেরিকার করপোরেশন আইনজীবীদের কাজকর্ম সে রকম।