স্থানের ব্যাপারে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই যে, স্থান কোনো বস্তুসত্তা নয়, যেমনটি নিউটন মনে করতেন এবং লুসিপ্পাস আর ডেমোক্রিটাসও যে কথাই বলতেন। আবার, ডেমোক্রিটাসের ভাবনার মতো স্থান বস্তুগুলোর বিশেষণও নয়, বরং স্থান হচ্ছে সম্পর্কগুলোর একটি ব্যবস্থা, যেমনটি মনে করতেন লাইবনিজ। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি শূন্যতার অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তা কোনোভাবেই পরিষ্কার নয়। হয়তো বিমূর্ত লজিকের একটি বিষয় হিসেবে তাকে শূন্যতার সঙ্গে মেলানো যেতে পারে। আমরা বলতে পারি যে কোনো দুইটি জিনিসের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব থাকে, তা বেশি বা কম হতে পারে এবং সেই দূরত্বের মধ্যে কোনো বস্তু থাকে না। এ ধরনের মতকে অবশ্য আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে প্রয়োগ করা অসম্ভব। আইনস্টাইনের পর থেকে মনে করা হয় যে, দূরত্ব ব্যাপারটি ঘটনাগুলোর মধ্যকার ব্যাপার, বস্তুগুলোর মধ্যকার নয়, আর দূরত্বের সঙ্গে সময় এবং স্থানের সম্পর্ক আছে। এটা অবশ্যই একটি কারণগত ধারণা, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে একটি দূরত্বের মধ্যে কোনো ক্রিয়া ঘটে না। এই সবকিছুরই ভিত্তি অবশ্য প্রায়োগিক, যৌক্তিক নয়। তা ছাড়া আধুনিক মত ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ ছাড়া প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং তা করা হলে প্রাচীনকালের দার্শনিকদের কাছে তা বোধগম্য হতো না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পরমাণুবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিক বিকাশই নিউটনের পরম স্থানের তত্ত্ব, যে তত্ত্ব অসত্তাকে বাস্তব প্রমাণ করার সমস্যার মুখোমুখি। এই তত্ত্বের ব্যাপারে কোনো যৌক্তিক আপত্তি নেই। প্রধান আপত্তি হচ্ছে এই যে, পরম স্থানকে কোনোভাবেই জানা যায় না এবং সে কারণেই তা একটি প্রায়োগিক বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমান নয়। আরো বাস্তবিক আপত্তি হচ্ছে এই যে, পদার্থবিজ্ঞান পরম স্থানের ধারণা ছাড়াই চলতে পারে। কিন্তু পরমাণুবাদীদের কল্পিত জগৎ যৌক্তিকভাবে সম্ভব এবং বাস্তব জগতের সঙ্গে তার সাদৃশ্য প্রাচীনকালের অন্যান্য ধারার দার্শনিকদের কল্পিত জগতের চেয়ে অনেক বেশি।
ডেমোক্রিটাস তার তত্ত্বগুলোর বেশ বিশদ রূপরেখা তৈরি করেছিলেন এবং তার সেই রূপরেখার কিছু অংশ আগ্রহব্যঞ্জক। তিনি বলেন, প্রতিটি পরমাণু অভেদ্য এবং অবিভাজ্য কারণ তার মধ্যে কোনো শূন্য স্থান নেই। ছুরি দিয়ে যখন আপেল কাটা হয়, তখন আপেলের মধ্যে এমন কিছু শূন্য স্থান থাকা প্রয়োজন যার মধ্যে ছুরিটি ঢুকে যেতে পারে। আপেলটির মধ্যে যদি কোনো শূন্য স্থান না থাকত তা হলে তা হতো সীমাহীনভাবে কঠিন এবং সেই কারণে দৈহিকভাবে অবিভাজ্য। প্রতিটি পরমাণু অন্ত গতভাবে অপরিবর্তনীয়, বস্তুত, তা পারমিনাইডীয় এক। পরমাণুগুলো শুধু সঞ্চরণ করে, পরস্পরকে আঘাত করে এবং কখনো কখনো পাশাপাশি সজ্জিত হয়ে এমন আকার ধারণ করে যেগুলো আবার পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগতে পারে। নানা বিচিত্র আকারে পরমাণুগুলো সজ্জিত হতে পারে; আগুন গঠিত হয় ছোট ছোট চাকতির আকারের পরমাণুগুলোর সমন্বয়ে, আত্মাও তাই। পরমাণুগুলোর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণাবর্তের, যা থেকে বিভিন্ন ধরনের বস্তু উৎপন্ন হয় এবং যা থেকেই শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হয় বিশ্ব। বিশ্বের সংখ্যা অনেক, সেগুলোর কতিপয় সৃষ্টি লাভ করছে, কতিপয় বিলীয়মান। কতক বিশ্বের সূর্য নেই, চাঁদও নেই। আবার কতকগুলোর অনেকগুলো করে সূর্য ও চাঁদ আছে। প্রত্যেকটি বিশ্বের শুরু ও শেষ আছে। একটি বিশ্ব কোনো বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এই সৃষ্টিতত্ত্বটির সারকথা ব্যক্ত করা যেতে পারে কবি পি. বি. শেলির ভাষায় :
বিশ্বের পর বিশ্ব ঘূর্ণমান অনাদিকাল
সৃষ্টি হতে বিলয় অবধি,
নদীবক্ষে বুদবুদের মতো
ঝলকায়, ফেটে যায়, বয়ে চলে যায়।
প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে আদিমতম কাদা থেকে। প্রত্যেকটি জীবন্ত দেহে কিছু পরিমাণ আগুন থাকে, বেশিরভাগই মস্তিষ্কে আর বক্ষদেশে (এ বিষয়ে বিজ্ঞ মহলে মতভেদ আছে)। চিন্তা একধরনের গতি এবং সে কারণেই তা অন্যত্র গতি সঞ্চার করতে সক্ষম। প্রত্যক্ষণ ও চিন্তন ভৌত বা শারীরিক প্রক্রিয়া। প্রত্যক্ষণ দুই প্রকারের : ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষণ আর বুদ্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষণ। বুদ্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষণ নির্ভর করে শুধু প্রত্যক্ষণের বস্তুর ওপর। আর ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষণ আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপরও নির্ভর করে এবং সেই কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে। লকের মতো ডেমোক্রিটাসও মনে করতেন যে, উষ্ণতা, স্বাদ, রং-এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো আসলে প্রত্যক্ষণের বস্তুর মধ্যে থাকে না, ওগুলো আমাদের ইন্দ্রিয়সঞ্জাত। কিন্তু ওজন, ঘনত্ব এবং দৃঢ়তা-এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো বস্তুর মধ্যেই থাকে।
ডেমোক্রিটাস ছিলেন একজন আগাগোড়া বস্তুবাদী। আমরা দেখেছি, তার বিবেচনায় আত্মা পরমাণু দ্বারা গঠিত, আর চিন্তা একটি ভৌত বা শারীরিক প্রক্রিয়া। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো লক্ষ্য নেই; আছে শুধু যান্ত্রিক নিয়মে পরিচালিত পরমাণুগুলো। জনসমাজে প্রচলিত ধর্মের প্রতি ডেমোক্রিটাসের কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি অ্যানাক্সাগোরাসের মন-এর ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছিলেন। নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে, তিনি মনে করতেন জীবনের লক্ষ্য আনন্দ-উচ্ছলতা; আর তা অর্জন করার সর্বোত্তম উপায় মিতাচার ও সংস্কৃতিমান হওয়া। যা-কিছু প্রচণ্ড, যা-কিছু প্রবল আবেগপূর্ণ, তার সবই তিনি অপছন্দ করতেন। যৌনতার প্রতি তার সমর্থন ছিল না, কারণ তিনি বলতেন, যৌনতায় ইন্দ্রিয়সুখ দ্বারা চেতনা আচ্ছন্ন হয়। তিনি বন্ধুত্বকে মূল্য দিতেন, তিনি নারীদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করতেন এবং সন্তান-সন্ততির আকাক্ষা করতেন না, কারণ তাদের পড়াশোনা শেখানোর কাজে দর্শন বাধাগ্রস্ত হয়। এই সবকিছুর বিচারে তিনি ছিলেন অনেকটাই জেরেমি বেনথামের মতো। গ্রিকরা যাকে গণতন্ত্র বলত সেই ব্যবস্থার প্রতিও তার অনুরূপ ভালোবাসা ছিল।