দেখা যাবে, একটি বিষয়ে প্রত্যেকেই একমত হয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে এই মত যে, পূর্ণতার মধ্যে কোনো গতি থাকতে পারে না। কিন্তু এই বিষয়টিতে সবার মতই ছিল সমান রকম ভ্রান্ত। কারণ পূর্ণতার মধ্যে একটি বৃত্তাকার গতি থাকতে পারে, যদি সেই পূর্ণতা সদা বিরাজমান হয়। ধারণাটি ছিল এ রকম যে, একটি বস্তু কেবল একটি শূন্য স্থানের দিকেই গতি লাভ করতে পারে, আর পূর্ণতার মধ্যে তো কোনো শূন্য স্থান থাকতে পারে না। তাহলে এটা মনে করা যেতে পারে-এবং তা মনে করা হয়তো সঠিকই হবে যে, একটি পূর্ণ স্থানের মধ্যে কখনোই একটি গতির সূচনা ঘটতে পারে না, কিন্তু এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, সেখানে গতি কখনোই সম্ভব নয়। তবে গ্রিকদের ব্যাপারে এটা মনে হয় যে, তারা মনে করতেন হয় পারমিনাইডিসের অপরিবর্তনীয় জগতের ধারণাটিকে মেনে নিতে হবে, নয় শূন্যতাকে স্বীকার করতে হবে।
এখন অনস্তিত্বের বিরুদ্ধে পারমিনাইডিসের অবস্থানকে যৌক্তিকভাবে অকাট্য বলে মনে হয় এবং তার যুক্তিগুলোর পক্ষে আরো সমর্থন পাওয়া যায় এই আবিষ্কার থেকে যে, যেখানে কিছুই থাকে না সেখানে বাতাস থাকে (সেকালে যুক্তি আর পর্যবেক্ষণের মধ্যে এই রকম বিভ্রান্তিকর মিশ্রণ একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল)। আমরা পারমিনাইডিসের অবস্থানটিকে এভাবে প্রকাশ করতে পারি : আপনি বলছেন শূন্যতা আছে; আর শূন্যতা মানে কিছু নয়; অতএব সেটি শূন্যতা নয়। বলা যাবে না যে, পরমাণুবাদীরা এই যুক্তির পালটা জবাব দিয়েছিলেন। তারা শুধু দাবি করেছিলেন যে, তারা তা অগ্রাহ্য করতে চান। এই যুক্তির ভিত্তিতে অগ্রাহ্য করতে চান যে, গতি হচ্ছে। অভিজ্ঞতার একটি তথ্য আর সে কারণেই একটি শূন্যতা অবশ্যই আছে, তা সেই শূন্যতাকে কল্পনা করা যতই কঠিন কাজ বলে মনে হোক না কেন।
এখনই এই সমস্যার পরবর্তীকালীন ইতিহাস বিবেচনা করা যাক। এ ব্যাপারে যুক্তির জটিলতা এড়ানোর প্রথম ও সবচেয়ে সোজা পথ হচ্ছে বস্তু ও স্থান-এর মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, স্থান কিছু নয়, বরং স্থানের প্রকৃতি একটি আধার বা পাত্রের মতো, যার কোনো অংশ কোনো বস্তু দ্বারা পূর্ণ থাকতে পারে আবার না-ও থাকতে পারে। অ্যারিস্টটল বলছেন (Physics, 208 b) : শূন্যতার অস্তিত্ব আছে-এই তত্ত্ব স্থানের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত, কেননা লোকে শূন্যতাকে এমন একটি স্থান বলে সংজ্ঞায়িত করে যেখানে কোনো বস্তু থাকে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন নিউটন, যিনি পরম স্থানের অস্তিত্ব আছে বলে দাবি করেছেন এবং একইভাবে আপেক্ষিক গতি থেকে পরম গতিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছেন। কোপার্নিকান বিতর্কের উভয় পক্ষই (যত অল্পই তারা বিষয়টি বুঝে থাকুন না কেন) এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে ছিলেন, কারণ তারা মনে করতেন যে, আকাশমণ্ডলী পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে আবর্তিত হয় আর পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘোরে-এই দুই কথার মধ্যে পার্থক্য আছে। যদি সব গতিই আপেক্ষিক হয় তাহলে এই দুই বাক্য আসলে একই বক্তব্যের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। যেমন জন জেমসের পিতা আর জেমস জনের পুত্র। কিন্তু সব গতি যদি আপেক্ষিক হয় আর স্থান কোনো বস্তু দ্বারা পূর্ণ না হয়, তাহলে আমাদের হাতে শূন্যতার বিরুদ্ধে পারমিনাইডিসের যুক্তিগুলো ছাড়া আর কিছু থাকে না।
ডেমোক্রিটাসের যুক্তিগুলো ছিল আদি গ্রিক দার্শনিকদের যুক্তিগুলোর মতোই। তিনি বলেন যে, বিস্তার বা প্রসারণ হচ্ছে বস্তুর সারসত্তা এবং সে কারণেই বস্তু সর্বত্র বিরাজমান। তার কাছে প্রসারণ বিশেষণ, বিশেষ্য নয়। বস্তুর বিশেষ্য হচ্ছে বন্ধুত্ব এবং বস্তুত্ব ছাড়া বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। তিনি মনে করেন, সুখী লোকের সুখের অনুভূতি ছাড়া যেমন সুখ-এর কথা চিন্তা করা যায় না, তেমনই শূন্য স্থানও একটি উদ্ভট বা অর্থহীন ধারণা। কিছুটা ভিন্ন ভিত্তি থেকে লাইবনিজও পূর্ণতায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন যে, স্থান হচ্ছে একটি সম্পর্ক-ব্যবস্থা (state of relations)। এই বিষয়ে লাইবনিজ ও নিউটনের মধ্যে সাড়া-জাগানো এক বির্তক ছিল, যে-বিতর্কে নিউটনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ক্লার্ক। আইনস্টাইনের সময় পর্যন্ত ওই বিতর্ক অমীমাংসিত ছিল। আইনস্টাইনের তত্ত্ব লাইবনিজকে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী ঘোষণা করেছে।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানী যদিও বিশ্বাস করেন যে, বস্তু এক অর্থে পারমাণবিক, কিন্তু তিনি মনে করেন না যে, শূন্য স্থান বলে কিছু আছে। যেখানে কোনো বস্তু নেই সেখানেও একটা কিছু থাকে, যেমন আলোকতরঙ্গ থাকে। পারমিনাইডিসের যুক্তিগুলোর কল্যাণে দর্শনশাস্ত্রে বস্তু এককালে যে উচ্চমর্যাদা অর্জন করেছিল তা পরবর্তীকালে আর বজায় থাকেনি। বস্তু অপরিবর্তনীয় দ্রব্য নয়, বরং তা ঘটনাগুলোর গোষ্ঠীভেদের একটি উপায় মাত্র। কিছু কিছু ঘটনা এমন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত যে গোষ্ঠীকে বস্তুগত বলে মনে করা যেতে পারে। অন্যগুলো, যেমন আলোকতরঙ্গ, ওই গোষ্ঠীতে পড়ে না। ঘটনাবলিই বিশ্বজগতের উপকরণ বা মালমসলা এবং সেগুলোর স্থায়িত্ব খুবই সংক্ষিপ্ত। এই অর্থে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান হেরাক্লিটাসের পক্ষে আর পারমিনাইডিসের বিপক্ষে। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের আগে পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান ছিল পারমিনাইডিসের পক্ষে।