ডেমোক্রিটাসের ব্যাপারটা অবশ্য সে রকম নয়। এ নামে একজন ব্যক্তির অস্তিত্ব যে ছিল তা মোটামুটি নিশ্চিত। তিনি প্রেস-এর অ্যাবডেরা নগরীর লোক ছিলেন। তার জীবনকাল সম্পর্কে বলতে গেলে উল্লেখ করতে হয় যে, তিনি নিজেই বলেছিলেন, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ সালে তিনি যখন যুবক ছিলেন, অ্যানাক্সাগোরাস তখন বৃদ্ধ। জ্ঞানের সন্ধানে তিনি দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ভ্রমণ করেছিলেন। সম্ভবত মিসরে তিনি উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত করেন এবং নিশ্চিতভাবে পারস্যও ভ্রমণ করেছিলেন। তার পর তিনি অ্যাবডেরায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। জেলার বলেছেন তার পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক সব দার্শনিকের মধ্যে সেরা।
ডেমোক্রিটাস ছিলেন সক্রেটিস ও সফিস্টদের সমসাময়িক, তবে শুধু কালক্রমের ভিত্তিতে তাকে আরো পরের দিকে দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, তাকে লুসিপ্পাস থেকে আলাদা করা খুবই কঠিন। এ কারণেই আমি তাকে সক্রেটিস ও সফিস্টদের পূর্ববর্তীকালে ফেলতে চাই, যদিও তার দর্শনের কিছু অংশ ছিল তার সমসাময়িক ও একই নগরীর বাসিন্দা এবং সফিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সফিস্ট প্রোটাগোরাসের মতামতগুলোর জবাব। প্রোটাগোরাস যখন এথেন্স যান। তখন তিনি সোৎসাহ অভ্যর্থনা লাভ করেন। অন্যদিকে ডেমোক্রিটাসকে বলতে শুনি, আমি এথেন্স গিয়ে দেখলাম সেখানকার কেউই আমাকে চেনে না। দীর্ঘকাল ধরে এথেন্সে তার দর্শন অবহেলিত ছিল। বার্নেট বলেন, প্লেটো ডেমোক্রিটাস সম্বন্ধে কিছু জানতেন কি না তা পরিষ্কার নয়…অন্যদিকে অ্যারিস্টটল ডেমোক্রিটাসকে ভালোভাবেই জানতেন, কারণ তিনিও ছিলেন উত্তরাঞ্চলের আয়োনিয়ার লোক। প্লেটো তার কোন সংলাপে কখনো ডেমোক্রিটাসের কথা উল্লেখ করেননি। বরং, ডায়োজিনিস লিরাটিয়াস বলেন যে, প্লেটো ডেমোক্রিটাসকে এতটাই অপছন্দ করতেন যে তিনি চেয়েছিলেন তার সব বই পুড়িয়ে ফেলা হোক। হিথ তাকে একজন গণিতজ্ঞ হিসেবে উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন।
ডেমোক্রিটাস, না হলে লুসিপ্পাস পারমিনাইডিসের উপস্থাপিত একত্ববাদ ও এম্পিডক্লিসের উপস্থাপিত বহুতুবাদের মধ্যে মধ্যস্থতা সাধনের প্রয়াস চালাতে গিয়ে পরমাণুবাদে উপনীত হন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো লক্ষণীয়ভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের মতো ছিল। গ্রিক চিন্তাজগতে যে ধরনের ত্রুটির প্রবণতা ছিল তারা সেগুলো অধিকাংশই এড়াতে পেরেছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক বস্তু পরমাণু দ্বারা গঠিত, পরমাণু গাঠনিকভাবে অবিভাজ্য, জ্যামিতিকভাবে নয়; এবং তারা মনে করতেন যে, পরমাণুগুলোর মাঝে মাঝে শূন্য জায়গা থাকে, পরমাণু ধ্বংসযোগ্য নয়, পরমাণু সর্বদা গতিশীল ছিল, গতিশীল আছে এবং গতিশীল থাকবে। পরমাণুর সংখ্যা অসীম, প্রকারভেদও অসীম এবং তাদের মধ্যকার পার্থক্যগুলো হয় তাদের গাঠনিক রূপ ও আকার অনুসারে। অ্যারিস্টটল বলেন, পরমাণুবাদীদের মত অনুসারে তাপভেদেও পরমাণুগুলো পরস্পর থেকে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, বর্তুলাকার পরমাণুতে আগুন থাকে এবং তা হয় সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত। ওজনভেদেও পরমাণুর মধ্যে বিভিন্নতা থাকে। তিনি ডেমোক্রিটাসকে উদ্ধৃত করেছেন, পরমাণুর অবিভাজ্যতা যত বাড়ে তার ওজনও তত বাড়ে। কিন্তু পরমাণুবাদীগণের তত্ত্বে পরমাণুর আসলেই ওজন আছে কি না তা একটি বিতর্কিত বিষয়। পরমাণু সর্বদা গতিশীল, কিন্তু ভাষ্যকারদের মধ্যে পরমাণুর আদি গতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বিশেষত জেলার বলেন, মনে করা হতো যে, পরমাণু সর্বদাই পতনশীল এবং সবচেয়ে ভারী পরমাণুগুলো সবচেয়ে দ্রুত গতিতে পতিত হয়, এভাবে পতনশীল অবস্থায় তারা হালকা পরমাণুগুলোকে ধরে ফেলে, তার ফলে অভিঘাত সৃষ্টি হয় এবং পরমাণুগুলো বিলিয়ার্ড বলের মতো পার্শ্বমুখে বিচ্যুত হয়। এটা ছিল নিশ্চিতভাবে এপিকুরাসের মত, যিনি অ্যারিস্টটলের সমালোচনা মোকাবিলা করতে গিয়ে অসচেতনভাবে নিজের তত্ত্বকে দাঁড় করিয়েছেন ডেমোক্রিটাসের তত্ত্বের ভিত্তির ওপর। কিন্তু এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। যে, লুসিপ্লাসের ও ডেমোক্রিটাসের তত্ত্বে ওজন পরমাণুর কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল না। বরং এটাই আরো সম্ভবপর মনে হয় যে, তাদের মতে, আদিতে পরমাণুগুলো। এলোমেলোভাবে সঞ্চরণশীল ছিল, যেমনটি দেখা যায় গ্যাসের গতিবিদ্যা সম্পর্কিত আধুনিক তত্ত্বে। ডেমোক্রিটাস বলেন অসীম শূন্যতার মধ্যে উপর বা নিচ বলে কিছু নেই; তিনি আত্মার পরমাণুর গতিকে বায়ুহীন পরিবেশে সূর্যরশ্মির কণিকার গতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এটা এপিকুরাসের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমার মনে হয় আমরা এটিকে লুসিপ্পাস ও ডেমোক্রিটাসের অভিমত বলে ধরে নিতে পারি।
পরমাণুগুলোর সংঘর্ষের ফলে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়। এই আলোচনার বাকিটা অ্যানাক্সাগোরাসের আলোচনার অনুরূপ। তবে অ্যানাক্সাগোরাস বলেন, পরমাণুর ঘূর্ণাবর্ত মনের ক্রিয়ার ফল কিন্তু এই আলোচনা তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে ঘূর্ণাবর্তকে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করে।
পরমাণুবাদীদের প্রাচীনকালে সাধারণভাবে নিন্দা করা হতো এই বলে যে, তারা আকস্মিকতাকে সবকিছুর পেছনের কারণ মনে করেন। কিন্তু আসলে তারা ছিলেন ঠিক তার উলটো প্রকৃতির, কঠোর নিমিত্তবাদী। তারা মনে করতেন সবকিছুই ঘটে কতকগুলো প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে। কোনো কিছু আকস্মিকভাবে ঘটে এ কথা ডেমোক্রিটাস পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করেছেন। ব্যক্তি লুসিপ্লাসের অস্তিত্ব নিয়ে যদিও প্রশ্ন আছে, তবু জানা যায় যে তিনি বলেছিলেন, কোনো কিছুই অকারণে ঘটে না; প্রত্যেক ঘটনারই ভিত্তি থাকে, একটি অনিবার্য কারণ থাকে। তবে এ কথা সত্য যে, বিশ্বজগৎ আদিতে যেমন ছিল তা কেন তেমনটি হয়েছে এর কোনো কারণ তিনি বলেননি; সম্ভবত তিনি এর পেছনে আকস্মিকতাকে দায়ী করেছেন। কিন্তু বিশ্বজগৎ একবার যখন অস্তিত্ব লাভ করেছে তখন তার পরবর্তী বিকাশ অপরিবর্তনীয়রূপে নির্ধারিত হয়েছে কতগুলো যান্ত্রিক নিয়ম দ্বারা। পরমাণুর আদি গতির কারণ ব্যাখ্যা না করার জন্য অ্যারিস্টটলসহ অনেকেই তার ডেমোক্রিটাসের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরমাণুবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাদের সমালোচকদের চেয়ে অধিকতর বিজ্ঞানভিত্তিক। কারণের সূত্রপাত অবশ্যই কিছু-একটা থেকে, আর যখন তা শুরু হয় তখন তার সূচনার পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে না। হয়তো বিশ্বজগৎ একজন স্রষ্টার সৃষ্টি, কিন্তু তা হলেও স্রষ্টা তার জন্য দায়ী নন। বস্তুত, পরমাণুবাদীদের তত্ত্ব প্রাচীনকালের অন্যান্য তত্ত্বাদির তুলনায় আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের অনেক কাছাকাছি।