অ্যানাক্সাগোরাস মনে করতেন, সবকিছুই অসীমরূপে বিভাজ্য এবং মনে করতেন যে, বস্তুর ক্ষুদ্রতম অংশের মধ্যেও তার প্রত্যেকটি উপাদানের কিছু কিছু অংশ বিদ্যমান থাকে। যে উপাদান সবচেয়ে বেশি মাত্রায় উপস্থিত থাকে বস্তু সেই রূপ ধারণ করে। এভাবে, দৃষ্টান্তস্বরূপ, প্রত্যেক বস্তুতে কিছু পরিমাণ আগুন থাকে, কিন্তু আমরা কেবল তখনই সেটাকে আগুন বলব যখন তার মধ্যে আগুন উপাদানটি সর্বাধিক মাত্রায় উপস্থিত থাকে। এম্পিডক্লিসের মতো অ্যানাক্সাগোরাসও মনে করতেন শূন্যতা বলে কিছু নেই বলে মনে হয়, কিন্তু তার মধ্যে আসলে বায়ু থাকে।
মন-এর ব্যাপারে অ্যানাক্সাগোরাসের অভিমত তার পূর্বসূরিদের চেয়ে আলাদা। তার মতে, মন একটি সত্তা, যা জীবন্ত বস্তুগুলোর দেহে প্রবেশ করে এবং মৃত বস্তুগুলো থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। তিনি বলেন, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে মনও থাকে। জীবন্ত সব কিছুর ওপর মনের একটি ক্ষমতা রয়েছে-মন অসীম এবং স্বনিয়ন্ত্রিত, মন কোনো কিছুর সঙ্গেই মিশ্রিত হয় না। মন ছাড়া বাকি সব কিছুর মধ্যেই, তা যতই ক্ষুদ্র হোক, সব বিপরীত ধর্ম বিদ্যমান থাকে। যেমন-তপ্ত ও শীতল, সাদা ও কালো ইত্যাদি। তিনি মনে করতেন তুষার কালো (আংশিকভাবে)। মন সব গতির উৎস। মন ঘূর্ণন সৃষ্টি করে আর ঘূর্ণন ক্রমান্বয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয় এবং তার ফলে সবচেয়ে হালকা বস্তুগুলো পরিধি-প্রান্তের দিকে ধাবিত হয়, আর সবচেয়ে ভারী বস্তুগুলো কেন্দ্রাভিমুখে পতিত হয়। মনের রূপ একটিই; পশুর মন ও মানুষের মনের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। মানুষ যে অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে উচ্চতর তার কারণ তার হাত আছে। আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধির যেসব পার্থক্য দেখা যায় তার প্রকৃত কারণ দৈহিক আকারের পার্থক্য।
অ্যারিস্টটল এবং প্লেটো-বর্ণিত সক্রেটিস-উভয়েরই অভিযোগ এই যে, অ্যানাক্সাগোরাস মন সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনা প্রবর্তনের পর তিনি মনের ব্যবহার করেছেন খুব অল্পই। অ্যারিস্টটল খেয়াল করেছেন, অ্যানাক্সাগোরাস মনকে একমাত্র কারণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, অন্য কোনো কারণের কথা তিনি জানতেন না। যখন তিনি পারতেন তখনই একটি যান্ত্রিক ব্যাখ্যা হাজির করতেন। বস্তুর উৎপত্তির কারণ হিসেবে অনিবার্যতা ও আকস্মিতাকে তিনি নাকচ করেছেন। কিন্তু তথাপি তার সৃষ্টিতত্ত্বে কোনো ঈশ্বর নেই। মনে হয়, নীতিশাস্ত্র ও ধর্ম নিয়ে তার তেমন চিন্তা ভাবনা ছিল না। সম্ভবত তিনি নাস্তিক ছিলেন, যেমনটি তার অভিযোগকারীরা দাবি করেছিল। এক পিথাগোরাস ছাড়া তার সব পূর্বসূরির প্রভাব তার মধ্যে ছিল। তার ওপর পারমিনাইডিসের প্রভাব ছিল ঠিক এম্পিডক্লিসের ওপর পারমিডিসের প্রভাবের মতো।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অ্যানাক্সাগোরাসের কৃতিত্ব বিরাট। তিনিই প্রথম বলেন যে চাঁদের আলো তার নিজস্ব নয়, চাঁদ আলোকিত হয় প্রতিফলিত আলোয়। অবশ্য পারমিনাইডিসের মধ্যেও একটি দুর্বোধ্য অংশ আছে, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনিও এটা জানতেন। অ্যানাক্সাগোরাস চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সঠিক তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে চাঁদের অবস্থান সূর্যের নিচে। তিনি বলেন, সূর্য ও নক্ষত্রগুলো একেকটা আগুনের পাথর, কিন্তু আমরা নক্ষত্রের তাপ অনুভব করি না কারণ সেগুলো অনেক অনেক দূরে। সূর্যের আকার পেলোপনেয়াসের চেয়ে বড়। চাঁদে পাহাড়-পর্বত আছে এবং সেখানে তিনি মনে করতেন) জীবের অস্তিত্বও আছে।
বলা হয়, অ্যানাক্সাগোরাস অ্যানাক্সামেনিসের দার্শনিক ধারার অনুসারী। এটা নিশ্চিত যে তিনি আয়োনীয়দের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। পিথাগোরাস থেকে সক্রেটিস এবং সক্রেটিস থেকে প্লেটোর হাত ধরে নীতিশাস্ত্র ও ধর্মবিষয়ক চিন্তাভাবনার যে আধিক্যের ফলে গ্রিক দর্শনে বিজ্ঞানবিরোধী ধর্মীয় ঝোঁক ঢুকে পড়ে, অ্যানাক্সাগোরাসের মধ্যে তা দেখতে পাওয়া যায় না। তিনি নিশ্চয়ই প্রথম স্থানীয় নন, কিন্তু তিনি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনিই প্রথম এথেন্সে দর্শন এনেছিলেন এবং সক্রেটিসের মানসগঠনে তার প্রভাব ছিল অন্যতম।
০৯. পরমাণুবাদীগণ
পরমাণুবাদের প্রতিষ্ঠাতা দুজন : লুসিপ্পাস ও ডেমোক্রিটাস। তাদেরকে পরস্পর থেকে আলাদা করা কঠিন, কারণে দর্শনের ইতিহাসে সাধারণভাবে তাদেরকে একইসঙ্গে উল্লেখ করা হয় এবং দৃশ্যত লুসিপ্লাসের অনেক কাজ পরবর্তীকালে ডেমোক্রিটাসের কাজ বলে পরিচিতি লাভ করেছে।
মিলেটাসের বাসিন্দা ছিলেন লুসিপ্পাস এবং ওই নগরীর বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী দর্শনের ধারার অনুসারী ছিলেন। সম্ভবত তার জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৪০ সালে। তার ওপর পারমিনাইডিসের ও জেনোর বেশ প্রভাব ছিল। তার সম্পর্কে তথ্য এত কম যে, এপিকুরাস (ডেমোক্রিটাসের একজন উত্তরকালীন অনুসারী) তার অস্তিত্ব পুরোপুরিই অস্বীকার করেছেন, আধুনিককালে কেউ কেউ এপিকুরাসের এই মত পুনরুত্থাপন করেছেন। তবে অ্যারিস্টটলের রচনায় লুসিপ্পাস সম্বন্ধে কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় (পাঠের উদ্ধৃতিসহ)। লুসিপ্পাস যদি নিছক একজন পৌরাণিক ব্যক্তি হতেন তাহলে অ্যারিস্টলের রচনায় তার উদ্ধৃতিসহ তার সম্পর্কে উল্লেখ থাকা সম্ভব ছিল না।