আটিকা ছিল ঐতিহাসিক যুগের প্রারম্ভে একটি স্বনির্ভর কৃষিজীবী অঞ্চল; এথেন্স ছিল তার রাজধানী। এথেন্স বৃহৎ নগরী ছিল না, কিন্তু সেখানে শিল্পী, কারিগর, মিস্ত্রি প্রভৃতির একটি বর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, যারা তাদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করতে চাইত। ধীরে ধীরে খেয়াল করা যায় যে, শস্যদানা উৎপাদন ও বিশেষত কৃষ্ণসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে শস্যদানা আমদানি করার চেয়ে আঙুর ও জলপাই চাষ অধিকতর লাভজনক। এ ধরনের কৃষিকাজে শস্যদানা ফলানোর চেয়ে বেশি পুঁজির প্রয়োজন হতো, ফলে ছোট ছোট চাষীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ত। অন্যান্য গ্রিক নগরীগুলোর মতো হোমারের যুগে আটিকায় স্বৈরতন্ত্র ছিল, কিন্তু সেখানকার রাজা নেহায়েত একজন ধর্মীয় কর্মচারীতে পরিণত হন, যার কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। শাসনক্ষমতা অভিজাতদের হাতে চলে যায়, যারা একইসঙ্গে গ্রামীণ কৃষক ও শহুরে শিল্পী-কারিগরদের ওপর শোষণ-নিপীড়ন চালাত।
ষষ্ঠ শতকের শুরুর দিকে সোলন এসে গণতন্ত্রমুখী একটি সমঝোতা সাধন করেন এবং তার অধিকাংশ কাজ রক্ষা পায় পরবর্তী স্বৈরতান্ত্রিক যুগে পেইসিস্ট্রেটাস ও তার পুত্রদের হাতে। সেই যুগের শেষে অভিজাততন্ত্রীরা স্বৈরতন্ত্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদেরকে গণতন্ত্রের শক্তি বলে সুপারিশ করে। পেরিক্লিসের পতনের আগ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দ্বারা অভিজাতদের হাতে ক্ষমতা সঞ্চিত হতে শুরু করে, যেমনটি ঘটেছে ১৯ শতকের ইংল্যান্ডে। কিন্তু পেরিক্লিসের জীবনাবসানের প্রাক্কালে এথেনীয় গণতন্ত্রের নেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরাট অংশভাগের দাবি জানাতে আরম্ভ করে। একইসঙ্গে তার যে সাম্রাজ্যবাদী নীতির দ্বারা এথেন্সের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সেই নীতির কারণে স্পার্টার সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত পোলোপনেসীয় যুদ্ধ (৪৩১-৪০৪ খ্রি.পূ.) বেধে যায়, যে যুদ্ধে এথেন্সের সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটে।
রাজনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও এথেন্সের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থেকে যায় এবং প্রায় এক হাজার বছর ধরে দর্শনচর্চা চলে এথেন্সকে কেন্দ্র করে। গণিত ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আলেকসান্দ্রিয়া এথেন্সকে ছাড়িয়ে যায় বটে, কিন্তু প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের কল্যাণে দর্শনের ক্ষেত্রে এথেন্স সর্বোচ্চ স্থানে উঠে যায়। প্লেটো যে একাডেমিতে শিক্ষা দিতেন, তা অন্য সব বিদ্যায়তনের চেয়ে অনেক বেশি দিন ধরে টিকে ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরের পরেও দুই শতাব্দী ধরে প্লেটোর একাডেমি টিকে ছিল পৌত্তলিক ধর্মের একটি দ্বীপের মতো। অবশেষে, ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তার পর ইউরোপে অন্ধকার যুগ নেমে আসে।
০৮. অ্যানাক্সাগোরাস
দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাস যদিও পিথাগোরাস, হেরাক্লিটাস বা পারমিনাইডিসের সমকক্ষ ছিলেন না, তবু তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি ছিলেন একজন আয়োনীয় এবং আয়োনিয়ার বৈজ্ঞানিক, যুক্তিবাদী ঐতিহ্যের অনুগামী ছিলেন। তিনিই প্রথম এথেন্সবাসীর কাছে দর্শনকে পরিচিত করেন এবং তিনিই বলেন যে, ভৌত পরিবর্তনের প্রাথমিক কারণ হচ্ছে মন।
খ্রি.পূ. ৫০০ অব্দে অ্যানাক্সাগোরাস জন্মগ্রহণ করেন, আয়োনিয়ার ক্ল্যাজোমেনিতে। কিন্তু জীবনের প্রায় ৩০ বছর, আনুমানিক ৪৬২ থেকে ৪৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অতিবাহিত করেন এথেন্স নগরীতে। তিনি সম্ভবত এথেন্স আসতে সম্মত হয়েছিলেন পেরিক্লিসের উৎসাহের প্রতি সাড়া দিয়ে। পেরিক্লিস তার সময়কার নাগরিকদের সাংস্কৃতিক উন্নতি ঘটানোর ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। মিলেটাস থেকে আগত অ্যাসপাসিয়া সম্ভবত অ্যানাক্সাগোরাসকে পেরিক্লিসের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। প্লেটো তার ফিড্রাস সংলাপে লিখেছেন : পেরিক্লিস মনে হয় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অ্যানাক্সাগোরাসের প্রতি-যিনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন এবং ঊর্ধ্বলোকের বস্তুপুঞ্জ সম্বন্ধে তার তত্ত্বালোচনা শুনে তৃপ্তি পেতেন এবং তার কাছ থেকে বুদ্ধি ও ভ্রান্তি র প্রকৃত স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মূলত এগুলোই ছিল অ্যানাক্সাগোরাসের আলোচ্য বিষয়। তার কাছ থেকেই তিনি (পেরিক্লিস) বাগ্মিতার কলায় আরো দক্ষতা অর্জনের কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন।
বলা হয় যে, অ্যানাক্সাগোরাস ইউরিপাইডিসকেও প্রভাবিত করেছিলেন। তবে এ ব্যাপারে বেশ সন্দেহ রয়ে গেছে। নিজেদের অভ্যস্ত সংস্কৃতির তুলনায় উচ্চতর কোনো সংস্কৃতির প্রচলনের প্রতি অন্যান্য যুগের অন্যান্য মহাদেশের অন্যান্য নগরীর বাসিন্দাদের মতো এথেন্সের লোকেরা কিছু মাত্রায় বিদ্বেষ পোষণ করত। পেরিক্লিসের যখন বার্ধক্য আসছিল তখন তার প্রতিপক্ষরা তার বন্ধু-বান্ধবদের আক্রমণের মধ্যে দিয়ে তার বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। তারা ফিডিয়াসের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলে যে, পেরিক্লিসের মূর্তি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ অর্থ ফিডিয়াস তসরুপ করেছেন। যারা ধর্ম পালন করে না এবং যারা ঊর্ধ্বলোকের বস্তুপুঞ্জ সম্বন্ধে তত্ত্ব শিক্ষা দেয় তাদের অভিশংসন করার সপক্ষে তারা একটি আইন পাস করে। সেই আইনে তারা অ্যানাক্সাগোরাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, তিনি শিক্ষা দিচ্ছিলেন যে সূর্য একটি উত্তপ্ত লাল পাথর আর চাঁদ হচ্ছে মাটি। (একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল সক্রেটিসের বেলায়, যিনি তার অভিযোগকারীদের সেকেলে ধ্যান-ধারণা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতেন। তার পর কী ঘটেছিল তা নিশ্চিত জানা যায় না। শুধু এটুকু জানা যায় যে, অ্যানাক্সাগোরাসকে এথেন্স ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছিল। এটা সম্ভবপর মনে হয় যে, পেরিক্লিস তাকে কারাগার থেকে বের করে এনেছিলেন এবং তার চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। অ্যানাক্সাগোরাস অতঃপর আয়োনিয়ায় ফিরে যান এবং সেখানে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তার ইচ্ছা অনুসারে তার মৃত্যুদিবস বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতো।