পেরিক্লিসের যুগ ছিল এথেন্সের ইতিহাসে সবচেয়ে সুখী ও গৌরবজনক অধ্যায়। ইস্কাইলাস, যিনি পারস্য যুদ্ধে লড়েছিলেন, তার হাতে গ্রিক ট্র্যাজেডির সূচনা। ট্র্যাজেডির উপজীব্য হিসেবে হোমারীয় বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে তার অন্যতম ট্র্যাজেডি পারসিতে ক্ষারভেস-এর পরাজয় তুলে ধরে। তার পরপরই দ্রুত চলে আসেন সফোক্লিস এবং সফোক্লিসের পর ইউরিপাইডিস। উভয় নাট্যকারই পেলোপনেসীয় যুদ্ধের অন্ধকার দিনগুলোতে প্রবেশ করেন, যা শুরু হয়েছিল পেরিক্সিসের পতন ও মৃত্যুর পর। ইউরিপাইডিস তার নাটকগুলোতে পরবর্তী যুগের সংশয়বাদের প্রতিফলন ঘটান। তার সমসাময়িক কমিক কবি অ্যারিস্টোফ্যানিস শক্তিশালী ও সীমিত সাধারণ জ্ঞানের অবস্থান থেকে সব রকমের মতবাদ নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেন। বিশেষত, সক্রেটিস জিউসের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন আর ছদ্ম বৈজ্ঞানিক গূঢ়তত্ত্বের চর্চা করেন-এই চিত্র এঁকে তিনি সক্রেটিসকে গণধিক্কারের মুখোমুখি ফেলেন।
ক্ষারভেস এথেন্স দখল করেছিলেন এবং সেখানকার মন্দিরগুলো আগুনে জ্বালিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। পেরিক্লিস সেগুলো পুনর্নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পারথেনন ও অন্যান্য যেসব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো নির্মিত হয়েছিল পেরিক্লিসের হাতে। দেবদেবীদের বিশাল বিশাল মূর্তি নির্মাণের জন্য ফেইডিয়াসকে রাষ্ট্রীয় স্থপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। সেই যুগের শেষ পাদে হেলেনিক জগতের মধ্যে এথেন্সই ছিল সবচেয়ে সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর নগরী।
ইতিহাসের জনক হেরোডটাস ছিলেন এশিয়া মাইনরের হ্যাঁলিকারনেসাস নগরীর সন্তান, কিন্তু তিনি বাস করতেন এথেন্স নগরীতে। এথেন্সের নগররাষ্ট্রের অনুপ্রেরণায় তিনি এথেন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে পারস্য যুদ্ধের একটি বিবরণ রচনা করেছিলেন। পেরিক্লিসের যুগে এথেন্সের অর্জন সম্ভবত পুরো ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর একটি বিষয়। তার আগে পর্যন্ত এথেন্স অন্য অনেক গ্রিক নগরীর চেয়ে অনেক পশ্চাৎপদ ছিল। শিল্পকলায় সাহিত্যে এথেন্স নগরী বড় কোনো প্রতিভার জন্ম দিতে পারেনি (শুধু সোলন ছাড়া, যিনি ছিলেন মূলত একজন আইনপ্রণেতা)। যুদ্ধে উৎসাহব্যঞ্জক বিজয়, সম্পদলাভ ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে আকস্মিকভাবে কতিপয় স্থপতি, ভাস্কর ও নাট্যকারের উদ্ভব ঘটে, যারা আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে গেছেন; তারা এমন কিছু সৃষ্টিকর্ম সাধন করেছেন যা পরবর্তী কালজুড়ে, একেবারে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল। এথেন্স নগরীর জনসংখ্যার কথা বিবেচনা করলে তাদের এই সাফল্য আরো বিস্ময়কর বলে মনে হয়। আনুমানিক ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স নগরীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার (দাস জনগোষ্ঠীসহ)। আর চতুস্পার্শ্বস্থ গ্রামীণ আটিকা অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল আরো কম। তার আগে বা পরে কোনো যুগেই এত অল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত কোন জাতির মধ্যে এমন উৎকর্ষ খেয়াল করা যায়নি।
দর্শনের ক্ষেত্রে এথেন্সের ফসল মাত্র দুই-সক্রেটিস ও প্লেটো। প্লেটো কিছুটা পরবর্তী সময়ের, কিন্তু সক্রেটিসের শৈশব ও প্রথম যৌবন কাটে পেরিক্লিসের যুগে। এথেন্সবাসীরা দর্শনের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। তারা অন্যান্য নগরী থেকে আগত দর্শন-শিক্ষকদের কথা আগ্রহভরে শুনত। তর্ক-বির্তকের কৌশল রপ্ত করতে আগ্রহী তরুণ-যুবকরা সফিস্টদের অন্বেষণে ঘুরত। প্লেটোর রচিত প্রোটাগোরাস সংলাপে দেখা যায়, প্লেটো-কল্পিত সক্রেটিস অন্যান্য নগরী থেকে আগত আগন্তুকদের কথাবার্তা এথেন্সের তরুণ-যুবকদের আগ্রহভরে শোনার এক চমৎকার বিদ্রুপাত্মক বিবরণ দিচ্ছেন। আমরা দেখব, পেরিক্লিস অ্যানাক্সাগোরাসকে এথেন্সে এনেছিলেন। সক্রেটিস বলেছিলেন যে, সৃষ্টিকর্মের মনের কাজটাই বড়-এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন অ্যানাক্সাগোরাসের কাছ থেকে।
প্লেটো তার অধিকাংশ সংলাপের ঘটনাকাল স্থাপন করেছিলেন পেরিক্লিসের যুগে। সেগুলোতে ধনী লোকজনদের জীবনযাপন সম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য চিত্র পাওয়া যায়। প্লেটো ছিলেন এথেন্সের একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান; তিনি বেড়ে উঠেছিলেন যুদ্ধ-পূর্ব যুগে, গণতন্ত্রের দ্বারা উচ্চ শ্রেণির সম্পদ ও নিরাপত্তা ধ্বংস হবার আগের ঐতিহ্যের মধ্যে। প্লেটোর সংলাপগুলোতে দেখা যায়, তরুণ-যুবকরা কোনো কাজ করে, তাদের কাজ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না, তারা তাদের অবকাশের অধিকাংশ সময় ব্যয় করত গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শনের পেছনে। তারা হোমারের রচনাগুলো প্রায় মুখস্থ জানে, তারা পেশাদার কবিতা-আবৃত্তিকারদের সমালোচকের দৃষ্টিতে বিচার করে। অবরোহমূলক চিন্তাপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে সদ্য, ফলে সত্য ও ভ্রান্ত সব ধরনের নতুন তত্ত্বের ব্যাপারেই তাদের মধ্যে উৎসাহ-উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সেই যুগে একইসঙ্গে চিন্তাশীল ও সুখী হওয়া, বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার মধ্য দিয়ে সুখী হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু যেসব শক্তির দ্বারা ওই স্বর্ণযুগের অবতারণা ঘটেছিল সেই শক্তিগুলোর মধ্যকার ভারসাম্য বিধান ছিল একটি অনিশ্চিত ব্যাপার। ভেতরের এবং বাইরের উভয় প্রকার ঝুঁকি ছিল। ভেতরের বিপদ ছিল গণতন্ত্র আর বাইরের বিপদ ছিল স্পার্টা। পেরিক্লিসের যুগে যা ঘটেছিল তা বোঝার জন্য ওই সময়ের আগেকার আটিকার ইতিহাস সংক্ষেপে বিবেচনা করা প্রয়োজন।