ক্রিটির অধিবাসীরা একজন অথবা সম্ভবত কয়েকজন দেবীর পূজা করত। দেবীদের মধ্যে যিনি ছিলেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাকে বলা হতো প্রাণিকুলের মালকিন। তিনি ছিলেন সম্ভবত একজন শিকারি মহিলা এবং তিনিই সম্ভবত ধ্রুপদী আরটেমিস দেবীর উৎস। দৃশ্যত তিনি একজন মাতাও ছিলেন। প্রাণিকুলের মালিকরা ছাড়া যে একমাত্র পুরুষ দেবতা ছিলেন, তিনি এই দেবীর যুবক পুত্র। মিসরীয়দের মতো ক্রিটির অধিবাসীদের ধর্মবিশ্বাসেও পরজীবন ছিল এমন প্রমাণ খেয়াল করা যায়। মিসরীয়দের মতো তারাও বিশ্বাস করত যে পৃথিবীতে তাদের কার্যকলাপ মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করবে। তবে সামগ্রিকভাবে তাদের শিল্পকলার নিদর্শনগুলো থেকে মনে হয় তারা মোটের ওপর হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছল মানুষ ছিল। বিষণ্ণ পরকালীন চিন্তার ছাপ তাদের মধ্যে খুব একটি ছিল না। ক্রিটি দ্বীপে ষাঁড়ের লড়াই বেশ জনপ্রিয় ছিল। ষাঁড়-লড়াইয়ে নারী ও পুরুষ লড়য়ারা সমান রকম দৈহিক পারদর্শিতা দেখাত।
স্যার আর্থার ইভান্স মনে করেন, ক্রিটিতে ষাঁড়ের লড়াই ছিল একধরনের ধর্মীয় উৎসব, যারা এ লড়াইয়ে অংশ নিত সমাজে তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হতো। তবে স্যার আর্থার ইভান্সের এই মত সর্বজনস্বীকৃত হয়নি। আমাদের কাল অবধি যেসব চিত্রকলা টিকে রয়েছে সেগুলো গতি আর বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। ক্রিটির অধিবাসীদের একটি রৈখিক হস্তলিপি ছিল, কিন্তু তার অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নিজেদের মধ্যে তারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত, তাদের নগরগুলো প্রাচীরবেষ্টিত ছিল না। এটা নিঃসন্দেহে এ কারণে যে তাদের ভূখণ্ড ছিল সমুদ্র দ্বারা সুরক্ষিত।
ধ্বংসের আগে মিনোয়ান সংস্কৃতি ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডের প্রসার লাভ করে। ক্রমবিকাশের বিভিন্ন ধাপে সে সংস্কৃতি সেখানে ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে এই সভ্যতা মাইসেনিয়ান সভ্যতা নামে পরিচিত। এটা জানা যায় রাজা-বাদশাদের সমাধি আর পাহাড়-চূড়ায় অবস্থিত দুর্গগুলোর নিদর্শন থেকে, যাতে যুদ্ধের ভয় বেশি করে প্রতিফলিত হয়েছে, যা কিনা ক্রিটি দ্বীপে ছিল না। সমাধি এবং দুর্গগুলো উভয়ই ধ্রুপদী গ্রিসের মানসে ছাপ ফেলেছে। এর আগেকার শিল্পকলার নিদর্শনগুলো-যেগুলো মিনোয়ান প্রাসাদগুলোতে পাওয়া যায়-হয় মূলত ক্রিটির কর্মনৈপুণ্যের লক্ষণ বহন করে, নয়তো সেগুলো ক্রিটি দ্বীপের লোকদেরই কর্মকুশলতার নিদর্শন। আর কাহিনি-উপকথার মধ্য দিয়ে মাইসেনীয় সভ্যতাকে দেখলে তাই পাওয়া যায়, যা আমরা হোমারের মারফতে পাই।
মাইসেনীয়দের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানা যায় না। তারাই কি সেই সভ্যতার ধারক ছিল যা ক্রিটির অধিবাসীরা অধিকার করে নিয়েছিল? তারা কি গ্রিক ভাষায় কথা বলত? অথবা তারা কি আরো পূর্ববর্তী প্রাচীন কোনো স্থানীয় জাতি ছিল? এইসব প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না। তবে এমন প্রমাণ মিলেছে যা এ ধরনের সম্ভাব্য উত্তর সরবরাহ করে যে, তারা সম্ভবত এক বিজয়ী জাতি ছিল যারা গ্রিক ভাষায় কথা বলত এবং ওই প্রমাণ থেকে অন্ততপক্ষে এমনটা মনে করা যায় যে, তাদের মধ্যকার অভিজাত শ্রেণিগুলো ছিল উত্তর থেকে আগত সোনালি চুলের আগ্রাসীর দল, যারা তাদের সঙ্গে করে গ্রিক ভাষা নিয়ে এসেছিল। গ্রিকরা গ্রিস দেশে এসেছিল পরপর তিনটি ধারায়। প্রথমে এসেছিল আয়োনিয়ান (lonians) নৃগোষ্ঠী, তারপর আকিয়ান (Achaeans) এবং সবশেষে ডরিয়ান (Dorian) নৃগোষ্ঠী। আয়োনীয়রা যদিও ছিল বিজয়ী আগ্রাসনকারী, তবু তারা বেশ ভালোভাবে ক্রিটির সভ্যতাকে গ্রহণ করে নিয়েছিল, যেমনটা পরবর্তীকালে রোমানরা গ্রহণ করেছিল গ্রিসের সভ্যতাকে। কিন্তু আয়োনীয়রা বাধাগ্রস্ত হয়, তাদের অধিকাংশকে উৎখাত করে পরবর্তী আগ্রাসী আকিয়ানরা। বোঘাজ-কুই নামক স্থানে প্রাপ্ত হিটাইট ফলক থেকে জানা গেছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকে আকিয়ানদের এক বিশাল সংগঠিত সাম্রাজ্য ছিল। আয়োনীয়রা, অর্থাৎ ডরিয়ানরা বস্তুত সেটাকে ধ্বংসই করে ফেলে। যেহেতু পূর্ববর্তী দখলদাররা মিনোয়ান সভ্যতাকে গ্রহণ করে নিয়েছিল সে জন্য ডরিয়ানরা তাদের পূর্বসূরিদের মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্মকে পরিত্যাগ করেনি, তারা তা সংরক্ষণ করেছিল। মাইসেনীয় ধর্ম টিকে ছিল বিশেষত নিম্নশ্রেণির লোকদের মধ্যে এবং ধ্রুপদী গ্রিসের ধর্ম ছিল মূলত দুটোর মিশ্রণ। আসলে ধ্রুপদী দেবীদের অনেকেরই উৎস ছিল মাইসেনীয়।
যদিও উপরের বিচারকে সম্ভবপর বলেই মনে হয়, তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা জানি না, মাইসেনীয়রা আসলেই গ্রিক ছিল কি না। আমরা যা জানি তা হলো, তাদের সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে। যখন তাদের সভ্যতার পরিসমাপ্তি ঘটে তখন ব্রোঞ্জের জায়গা দখল করে নিয়েছে লোহা এবং আরো জানি যে, কিছুকালের জন্য সমুদ্রের আধিপত্য চলে গিয়েছিল ফিনিসীয়দের হাতে। মাইসেনীয় যুগের শেষের দিকে এবং এ যুগ শেষ হবার পর-উভয় কালে দখলদারদের কিছু অংশ সেখানে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে এবং কৃষিজীবী হয়ে ওঠে। আর তাদের কিছু অংশ আরো অগ্রসর হয়ে প্রথমে এশিয়া মাইনরের দ্বীপগুলোতে, তারপর সিসিলি ও দক্ষিণ ইতালি পৌঁছে। সেখানে তারা নগর পত্তন করে এবং সমুদ্র-উপকূলীয় বাণিজ্যকে জীবিকা হিসেবে নেয়। এসব উপকূলীয় নগরীতেই গ্রিকরা তাদের সভ্যতার জন্য নতুন নতুন গুণগত অবদান রাখে। এথেন্সের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় পরবর্তী সময়ে, এ ক্ষেত্রে এথেন্স নৌশক্তির সহযোগিতা লাভ করে।