একসময় তিনি নিজের সম্বন্ধে এমন উচ্ছ্বসিতভাবে কথা বলেন যেন তিনি একজন দেবতা : আরকাগাসের হলুদ পর্বতরাজির দিকে তাকিয়ে তোমরা যারা এই মহান নগরীতে বাস করো, যারা নগরদুর্গের পাশে শুভকর্মে লিপ্ত থাকো, অতিথিদের সম্মান করো, সেই বন্ধুরা এবং সেই-সব অদক্ষ ও হীন মানুষেরা, তোমাদের সবাইকে স্বাগতম। তোমাদের মধ্যে আমি আছি-এক অবিনশ্বর দেবতা। যারা আমার সাক্ষাৎ লাভ করে তারা সবাই আমার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, চৌকো জালিকা ও পুষ্পমাল্যে আমাকে ভূষিত করে। সোজা কথা, আমি যখন নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণির লোকজনসহ বর্ধিষ্ণু নগরীগুলোতে প্রবেশ করি তখন আমাকে গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। অসংখ্য মানুষ দলে দলে আমার অনুগামী হয়, তারা জানতে চায় সাফল্যের পথ; কেউ কেউ ঐশী প্রত্যাদেশ পেতে চায়, আবার কেউ কেউ, যারা বহু দিন ধরে নানা ধরনের রোগে-শোকে ভুগছে, তারা আমার কাছে আরোগ্যের বাণী শুনতে চায়…কিন্তু কেন আমি এসব নিয়ে এত চিন্তা করি, যেন এটা কোনো বিরাট একটি ব্যাপার যে আমাকে নশ্বর মানুষদের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে?
অন্য এক জায়গায় দেখা যায়, তিনি নিজেকে একজন বড় পাপী বলে মনে করছেন যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত চলছে : অনিবার্যতার একটি প্রত্যাদেশ আছে, সেটা দেবতাদের এক প্রাচীন অধ্যাদেশ যা শাশ্বত এবং বড় বড় শপথে বাঁধা। সেই অধ্যাদেশটি হচ্ছে, শয়তানদের মধ্যে যখন কেউ নিজের হাত রক্তে রঞ্জিত করে পাপী হয়, অথবা সংঘর্ষের পথে যায় অথবা মিথ্যা শপথ করে, তাকে অবশ্যই আশীর্বাদপুষ্টদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে দশ হাজার বছরের তিনগুণ কাল ধরে ঘুরে বেড়াতে হয়। এই সময়ের মধ্যে নশ্বরদের যাবতীয় রূপে তার বারবার জন্ম হয়, এক জীবনের কষ্টকর পথ বদলে আরেক কষ্টকর জীবনের পথে তাকে অবিরাম ঘুরে ফিরতে হয়ে। মহাশক্তিধর বায়ু তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে আর সমুদ্র তাকে ছুঁড়ে দেয় শুষ্ক ভূপৃষ্ঠের দিকে; মাটি তাকে জ্বলন্ত সূর্যের কিরণরশ্মিতে নিক্ষেপ করে এবং সে পুনরায় বায়ুর ঘূর্ণিমধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। একে অন্যের কাছ থেকে তাকে গ্রহণ করে এবং সবাই তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এখন তাদের মধ্যকার একজন হলাম আমি, দেবতাদের কাছ থেকে নির্বাসিত একজন ভবঘুরে, কারণ আমি এক কাণ্ডজ্ঞানহীন সংঘর্ষে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। কী তার পাপ ছিল তা আমরা জানি না। সম্ভবত এমন কিছু নয় যা খুব গুরুতর ছিল। কারণ তিনি বলেন : হায়, আমার এ দুই ঠোঁট দিয়ে গোগ্রাসে ভক্ষণ করার মতো মন্দ কাজে মেতে ওঠার আগেই নিষ্করুণ মৃত্যুর দিন এসে কেন আমায় ধ্বংস করল না।…
লরেল পাতা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকো…
হতভাগার দল, শিম থেকে তোমাদের হাত দূরে রাখো।…
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তিনি লরেল পাতা চিবানো বা শিম গলাধঃকরণের চেয়ে গুরুতর খারাপ কিছু করেননি।
প্লেটোর রচনাবলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো সেই অংশটি যেখানে তিনি এই জগৎকে একটি গুহার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে গুহার মধ্যে বসবাসরত আমরা বাস্ত বকে দেখতে পাই না, বরং ঊর্ধ্বালোকে অবস্থিত উজ্জ্বল জগতের বাস্তবতার ছায়া দেখতে পাই। এ রকম রূপকের ধারণা প্লেটোর আগে এডিক্লিসের মধ্যে ছিল; এর উৎস অর্ফিকদের শিক্ষা। এমন কিছু লোক আছে যারা সম্ভবত কয়েক জনম ধরে পাপ থেকে বিরত থাকার ফলে অবশেষে দেবতাদের সান্নিধ্যে অনন্ত শান্তি লাভ করে : কিন্তু অবশেষে তারা নশ্বর মানুষদের মধ্যে ভবিষ্যদ্বক্তা, গীতি-রচয়িতা, চিকিৎসক এবং রাজকুমাররূপে আবির্ভূত হয় এবং সেখান থেকে তারা মর্যাদাবান দেবতা হয়ে ওঠে, যাদের আত্মা ও আসন দেবতাদের সমতুল্য হয়, তারা মানবীয় অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়, নিয়তি থেকে নিরাপদ থাকে এবং তাদের ওপর কোনো আঘাত আসতে পারে না। মনে হয়, এই সবকিছুর মধ্যে এমন কিছু খুব অল্প আছে যা ইতোপূর্বে অর্ফিজমের শিক্ষা ও পিথাগোরীয় মতবাদের মধ্যে দেখা যায়নি। বিজ্ঞানের বাইরে এম্পিডক্লিসের মৌলিকত্ব রয়েছে চারটি আদি উপাদানের তত্ত্বে এবং পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় প্রেম ও দ্বন্দ্ব-এই দুই নীতির ব্যবহারের মধ্যে। এম্পিডক্লিস অদ্বৈতবাদ নাকচ করেছেন, তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির গতি নিয়ন্ত্রিত হয় কোনো উদ্দেশ্য দ্বারা নয়, বরং আকস্মিকতা ও অনিবার্যতা দ্বারা। এসব বিবেচনায় তার দর্শন ছিল পারমিনাইডিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের চেয়ে অধিক মাত্রায় বিজ্ঞানভিত্তিক। সত্য যে, অন্যান্য দিকে সে যুগের প্রচলিত কুসংস্কারের প্রতি তার সায় ছিল; কিন্তু তাতে তিনি বর্তমানকালের অনেক বিজ্ঞানীর চেয়েও উন্নত ছিলেন।
০৭. সংস্কৃতিক্ষেত্রে এথেন্স
দুটি পারস্য যুদ্ধের কালে (খ্রি.পূ. ৪৯০ এবং খ্রি.পূ. ৪৮০-৪৭৯ অব্দ) এথেন্সের বিশালত্ব শুরু হয়। সেই যুগের আগে আয়োনিয়া ও ম্যাগনা গ্রেসিয়া (দক্ষিণ ইত্যাদি এবং সিসিলির গ্রিক নগরীগুলো) অনেক মহৎ পুরুষের জন্ম দিয়েছে। ম্যারাথন নামক স্থানে পারস্যের রাজা দারিউসের বিরুদ্ধে এথেন্সের বিজয় (৪৯০ খ্রি.পূ.) এবং তার পুত্র ও উত্তরসূরি ক্ষারখেস-এর বিরুদ্ধে এথেনীয় নেতৃত্বে সম্মিলিত গ্রিক নৌবহরে বিজয়ের ফলে (৪৮০ খ্রি.পূ.) এথেন্স বিরাট মর্যাদার আসনে উঠে যায়। দ্বীপগুলোতে এবং এশিয়া মাইনরের মূল ভূখণ্ডের কিছু অংশে আয়োনীয়রা পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আর পারসিকরা গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হবার পরে এথেনিদের দ্বারা আয়োনিদের স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হয়েছিল। স্পার্টার লোকেরা-যারা শুধু নিজেদের সীমানা নিয়েই ভাবিত ছিল-এই অভিযানে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এভাবে পারস্যের বিরোধী একটি জোটে এথেন্স প্রধান শরিক হয়ে ওঠে। ওই মিত্র জোটের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী প্রত্যেকটি সদস্যরাষ্ট্র একটি নির্দিষ্টসংখ্যক জাহাজের যোগান দিতে বা তার মূল্যমানের অর্থ প্রদান করতে বাধ্য ছিল। অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্রই জাহাজ না দিয়ে অর্থ পরিশোধ করত। ফলে এভাবে এথেন্স ধীরে ধীরে নৌশক্তিতে তার শরিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে এবং ক্রমে ওই মিত্র জোটকে একত্রিত করে একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। পেরিক্লিসের শাসনাধীনে এথেন্স ধনী ও সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। পেরিক্লিস নাগরিকদের স্বাধীন ইচ্ছাক্রমে ৩০ বছর শাসন করেন। ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে তার পতন ঘটে।