জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাপারে বলতে গেলে, তিনি জানতেন যে চাঁদের আলো তার নিজস্ব নয়, বরং প্রতিফলিত আলো এবং যদিও এ কথা সূর্যের ক্ষেত্রেও সত্য, তিনি বলেন যে, আলোর ভ্রমণের জন্য সময় লাগে, কিন্তু তা এত অল্প সময় যে আমরা তা খেয়াল করতে পারি না। তিনি জানতেন সূর্যগ্রহণ ঘটে চাঁদের স্থান পরিবর্তনের কারণে। মনে হয় তিনি এটা জেনেছিলেন অ্যানাক্সাগোরাসের কাছ থেকে। এম্পিডক্লিস ছিলেন ইতালীয় ধারার চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রবর্তক। তার থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে ধারার জন্ম হয়েছিল তা প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলকে প্রভাবিত করেছিল। বার্নেটের মত অনুসারে তা পুরো বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তার প্রবণতাকেই প্রভাবিত করেছিল। এসব থেকে এম্পিডক্লিসের যুগের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের শক্তিমত্তার প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়, পরবর্তী যুগের গ্রিসে যার সমকক্ষতা মেলে না।
এখন আসছি তার সৃষ্টতত্ত্ব সম্পর্কে। ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনিই এই মত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি হচ্ছে সৃষ্টির চারটি আদি উপাদান (অবশ্য উপাদান শব্দটি তিনি ব্যবহার করেননি। তার মতে এই উপাদানগুলোর প্রত্যেকটি চিরন্তন, তবে সেগুলো বিভিন্ন অনুপাতে পরস্পরের সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারে এবং সেই-সব যৌগিক পদার্থ উৎপন্ন করতে পারে যা আমরা পৃথিবীতে দেখতে পাই। এই উপাদানগুলো মিশ্রিত হয় প্রেম দ্বারা এবং বিচ্ছিন্ন হয় দ্বন্দ্ব দ্বারা। এম্পিডক্লিসের কাছে মাটি, বায়ু, আগুন ও পানির মতো প্রেম এবং দ্বন্দ্বও আদি উপাদান। কখনো প্রেম শক্তিশালীরূপে দেখা দেয়, আবার কখনো দ্বন্দ্ব অধিকতর শক্তিশালী হয়। একটি সোনালি যুগ ছিল, যখন পরিপূর্ণ বিজয় লাভ করেছিল প্রেম। সেই যুগে মানুষ শুধু সাইপ্রাসের আফ্রোদিতির পূজা করত। বিশ্বে যেসব পরিবর্তন ঘটে তা কোনো লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং তা ঘটে শুধু ঘটনাক্রমে এবং অনিবার্য কারণে। পরিবর্তনের একটি চক্র রয়েছে : উপাদানগুলো যখন প্রেম দ্বারা সম্পূর্ণরূপে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন দ্বন্দ্ব সেগুলোকে আবার ক্রমে বেছে বেছে আলাদা করে। দ্বন্দ্বের এই বিচ্ছিন্নকরণের প্রক্রিয়াটি যখন সম্পূর্ণ হয়ে যায়, অর্থাৎ উপাদানগুলো যখন সম্পূর্ণরূপে আলাদা হয়ে যায়, তখন প্রেম সেগুলোকে আবার ক্রমে একত্রিত করে। এভাবে সৃষ্ট প্রত্যেকটি যৌগিক পদার্থ অস্থায়ী। শুধু আদি উপাদানগুলো এবং প্রেম ও দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী। এম্পিডক্লিসের এই তত্ত্বের কিছুটা সাদৃশ্য আছে হেরাক্লিটাসের তত্ত্বের সঙ্গে। তবে এম্পিডক্লিসের তত্ত্বটি একটু নমনীয় কারণ এতে শুধু দ্বন্দ্ব নয়, তার সঙ্গে প্রেমও আছে। পরিবর্তন সাধন করে দ্বন্দ্ব এবং প্রেম একত্রে মিলে। প্লেটো তার সফিস্ট গ্রন্থে হেরাক্লিটাস ও এম্পিডক্লিসকে একত্রে জুড়েছেন এভাবে : আয়োনীয় এবং অতি অধুনা কিছু সিসিলীয় কাব্যদেবীর দেখা মেলে যারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। যে, দুই নীতির (একের এবং বহুর) মিলন ঘটানো অধিকতর নিরাপদ, নিরাপদ এই কথা বলা যে, সত্তা হচ্ছে এক এবং বহু, এ দুটি একত্রে বাঁধা থাকে শত্রুতা ও বন্ধুত্ব দ্বারা, তারা এই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, এই মিলিত হচ্ছে, যেমনটি বিচ্ছিন্নকারী দেবীরা বলে থাকেন। আর অধিকতর স্র দেবীরা নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও শান্তির কথাটার ওপরে জোর দেন না, বরং তাদের শৈথিল্য ও পর্যাক্রমিক আবর্তন স্বীকার করেন; আফ্রোদিতিরি শাসনে শান্তির ঐক্য প্রকট হয়ে ওঠে, তারপর দ্বন্দ্বের এক নিয়মহেতু জয়ী হয় বহুত্ব ও যুদ্ধ।
এম্পিডক্লিস মনে করতেন বস্তুজগৎ একটি গোলক; স্বর্ণযুগে দ্বন্দ্ব ছিল এর বাইরে আর প্রেম ছিল ভেতরে। তারপর ক্রমে দ্বন্দ্ব প্রবেশ করে এবং প্রেম বহিষ্কৃত হয়। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণরূপে ভেতরটা দখল করে নেয় এবং প্রেম সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কৃত হয়। তারপর কী এক অস্পষ্ট কারণে-একটি বিপরীতমুখী গতি শুরু হয়, কিন্তু সেটা চিরকাল চলে না, স্বর্ণযুগ ফিরে না আসা পর্যন্ত চলতে থাকে। কেউ মনে করতে পারে যে, দ্বন্দ্ব বা প্রেম যেকোনো একটির চূড়ান্ত রূপ স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু এম্পিডক্লিসের মতো তা নয়। তিনি গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন কেবল তখনই যখন পারমিনাইডিসের যুক্তি প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেছেন; কিন্তু কোনো পর্যায়েই তিনি এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাননি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অপরিবর্তনশীল।
ধর্ম সম্বন্ধে এম্পিডক্লিসের অভিমতগুলো প্রধানত পিথাগোরীয়। একটি অনুচ্ছেদে তিনি এই কথাগুলো যে ব্যক্তি সম্বন্ধে বলেছেন তিনি খুব সম্ভবত পিথাগোরাস : তাদের মধ্যে বিরল জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন সব ধরনের জ্ঞানদীপ্ত কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দক্ষ, তিনি অর্জন করেছিলেন প্রভূত জ্ঞানসম্পদ, কেননা যখন তিনি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছেন তখন খুব সহজেই মানুষে দশ-কুড়িটি জীবনের সমুদয় কিছু দেখতে পেয়েছেন। যেমনটি বলা হয়েছে, স্বর্ণযুগে মানুষ কেবল আফ্রোদিতির পূজা করত এবং তার বেদি ষাঁড়ের রক্তে সিক্ত হতো না, বরং মানুষ মনে করত প্রাণ হরণের পর প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভক্ষণ করা সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজ।