এই তর্কের জবাব দেবার চেষ্টা আমি এখন করব না। এ জন্য স্মৃতিসম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। সেটা একটি কঠিন বিষয়। এই তর্কটি আমি এখানে উল্লেখ করছি পাঠকদের এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য যে, দার্শনিক তত্ত্ব, যদি সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়, সেগুলো প্রথমে যেভাবে উপস্থাপিত হয় তা খণ্ডনের পরে আবার নতুন রূপে উপস্থাপিত হতে পারে। খণ্ডন কদাচিৎ চূড়ান্ত ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আরো পরিমার্জনার সূচনা মাত্র।
পারমিনাইডিসের পর থেকে অতি আধুনিককাল পর্যন্ত তার কাছ থেকে যা গ্রহণ করা হয়েছে তা সব ধরনের পরিবর্তনের অসম্ভবপরতা নয়, বরং সারবস্তুর অবিনাশ্যতা। তার অব্যবহিত পরবর্তী উত্তরসূরিদের মধ্যে অবশ্য সারবস্তু শব্দটার দেখা পাওয়া যায় না, কিন্তু এর ধারণাটি ইতোমধ্যেই তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। একটি সারবস্তুকে বিভিন্ন পরিবর্তনশীল বিধেয়র উদ্দেশ্য বলে বিবেচনা করা হতো। এভাবেই তা দর্শন, মনস্তত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বের একটি মৌলিক ধারণা হয়ে উঠেছিল এবং দুই হাজারেরও বেশি সময় ধরে তা টিকে রয়েছে। আপাতত আমি শুধু এটুকু উল্লেখ করতে চাই যে সারবস্তুর ধারণাটি চালু হয়েছিল দৃশ্যমান সত্যগুলো অস্বীকার না করে পারমিনাইডিসের যুক্তিগুলোর প্রতি সুবিচার করার একটি উপায় রূপে।
০৬. এম্পিডক্লিস
ইতোপূর্বে পিথাগোরাসের মধ্যে দেখা গেছে দার্শনিক, ভবিষ্যদ্বক্তা, বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকের মিশ্রণ। আর এসব বিদ্যার মিশ্রণের এক চমৎকার পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত ছিলেন এম্পিডক্লিস। তার আবির্ভাব আনুমানিক ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে দিক থেকে তিনি ছিলেন পারমিনাইডিসের একজন অনুজ সমসাময়িক, কিন্তু তার মতবাদ কিছু দিক থেকে হেরাক্লিটাসের মতবাদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তিনি ছিলেন সিসিলির দক্ষিণ উপকূলবর্তী আরকাগাস নগরীর নাগরিক, একজন গণতন্ত্রী রাজনীতিক, যিনি একইসঙ্গে নিজেকে একজন দেবতা বলেও দাবি করতেন। অধিকাংশ গ্রিক নগরীতে, বিশেষ করে সিসিলির গ্রিক নগরীগুলোতে, সে সময় গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে অবিরাম সংঘাত লেগে থাকত। যে পক্ষ পরাজিত হতো তার নেতাদের পরিণতি হতো মৃত্যুদণ্ড অথবা নির্বাসন। যারা নির্বাসনদণ্ড পেত তারা গ্রিসের শত্রুদের-পূর্বে পারস্য এবং পশ্চিমে কার্থেজ-এর সঙ্গে কোনো প্রকার সমঝোতা বা আলাপ-আলোচনায় যাবার তাগিদ বোধ করত না। একসময় এম্পিডক্লিসও নির্বাসিত হয়েছিলেন, তবে মনে হয় নির্বাসনের পর তিনি ষড়যন্ত্রপরায়ণ উদ্বাস্তু-জীবনের বদলে একজন ঋষির জীবন বেছে নেওয়াই শ্রেয় ভেবেছিলেন। এটা সম্ভবপর মনে হয় যে তিনি তরুণ বয়সে কমবেশি অর্ফিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন; নির্বাসনের আগের পর্বে তিনি একইসঙ্গে রাজনীতি ও বিজ্ঞানচর্চা করেছেন এবং পরবর্তী জীবনে, অর্থাৎ নির্বাসনকালেই কেবল একজন ভবিষ্যদ্বক্তা হয়েছিলেন।
এম্পিডক্লিস সম্বন্ধে অনেক কাহিনি-উপকথা প্রচলিত আছে, ধারণা করা হয় যে, তিনি নানা করম অলৌকিক কাজ-কারবার করতে পারতেন। কখনো এসব করতেন জাদুর সাহায্যে, কখনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাহায্যে। বলা হয় তিনি বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তিনি নাকি তিরিশ দিনের মৃত এক মহিলাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। আর বলা হয় যে, নিজেকে দেবতা প্রমাণ করার জন্য তিনি ইটনার একটি অগ্নিগিরির জ্বালামুখে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কবির ভাষায়–
মহান এম্পিডক্লিস, ব্যাকুল আত্মা,
ঝাঁপ দিলেন ইটনায়, ভস্ম হলেন পুরোটাই।
এ বিষয় নিয়ে ম্যাথিউ আরনল্ড একটি কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু সেটি ছিল তার কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট এবং তাতে উপরের চরণ দুটি ছিল না।
পারমিনাইডিসের মতো এম্পিডক্লিসও লিখতেন পদ্যাকারে। তার দ্বারা প্রভাবিত লুক্রোটিয়াস কবি হিসেবে তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে অভিমতগুলোর মধ্যে বিভাজন ছিল। এম্পিডক্লিসের রচনার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে, কেবল সামান্য কিছু খণ্ডাংশ আমাদের কাল অবধি টিকে রয়েছে। তাই তার কবি প্রতিভা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
এম্পিডক্লিসের বিজ্ঞানচিন্তা ও ধর্মচিন্তা পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে সেগুলোর আলোচনা করা প্রয়োজন পৃথকভাবে। আমি প্রথমে তার বিজ্ঞান, তারপর তার দর্শন এবং সবশেষে তার ধর্মচিন্তা নিয়ে আলোচনা করব। বিজ্ঞানে তার সবচেয়ে বড় অবদান এই যে, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বায়ু একটি পৃথক পদার্থ। এটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন এই পর্যবেক্ষণ থেকে যে, একটি বালতি বা যেকোনো পাত্রকে উলটা করে পানিতে রেখে দিলে তার মধ্যে পানি প্রবেশ করে না। তিনি বলেন : একটি বালিকা চকচকে পিতলের তৈরি একটি জলঘড়ি নিয়ে খেলা করছিল। জলঘড়ির পাইপের নলটি সে তার শান্ত হাতে নিলে, তারপর সেটি ঢুকিয়ে দিল জলঘড়ির রুপালি জলের ভেতরে, কিন্তু জল তখন পাত্রে প্রবেশ করল না, ভেতরের ঘনীভূত বায়ু জলকে প্রবেশ করতে দিল না। কিন্তু যখন সে ঢাকনাটি তুলল তখন বায়ু বেরিয়ে গেল এবং সমপরিমাণ জল প্রবেশ করল। শ্বাসক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটে এই অনুচ্ছেদটি তার ব্যাখ্যা হতে পারে।
এম্পিডক্লিস কেন্দ্রাভিমুখী শক্তির অন্তত একটি দৃষ্টান্তও আবিষ্কার করেছিলেন। সেটা হচ্ছে সুতোয় বাঁধা একটি পানিভর্তি কাপ যদি ঘোরানো হয়, তাহলে তা থেকে পানি পড়ে না। এম্পিডক্লিস জানতেন উদ্ভিদের লিঙ্গ আছে। বিবর্তন সম্পর্কে এবং যোগ্যতমের টিকে থাকা সম্পর্কে তার একটি তত্ত্ব ছিল (মানতেই হবে যে তা ছিল কাল্পনিক)। তিনি বলেন, এটা খেয়াল করার মতো একটি তাজ্জব ব্যাপার যে, আদিতে নানা আকারের নশ্বর জীবজন্তু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করত। ঘাড়বিহীন মাথা ছিল, কাঁধবিহীন বাহু ছিল, কপালবিহীন চোখ ছিল; একেকটা বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একত্রে মিলিত হবার চেষ্টা করত। এসব জিনিস যে যেমনটি সুযোগ পেত, একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতো। মাটি-ঘেঁষে-চলা অনেক প্রাণী ছিল যাদের ছিল অসংখ্য হাত। বিভিন্নমুখী একাধিক মুখমণ্ডল ও একাধিক বক্ষবিশিষ্ট অনেক প্রাণী ছিল। এমন প্রাণী ছিল যার দেহ ষাড়ের আর মুখমণ্ডল মানুষের। আবার এমন প্রাণীও ছিল যার দেহ মানুষের আর মুখমণ্ডল ষাঁড়ের। নারী ও পুরুষের প্রকৃতির সমন্বয়ে গঠিত উভলিঙ্গ জীব ছিল, কিন্তু তারা ছিল বন্ধ্যা। তবে শেষ পর্যন্ত কেবল নির্দিষ্ট কিছু আকারের প্রাণীই টিকে যায়।