তাহলে জর্জ ওয়াশিংটন সম্পর্কে আমরা কী বলব? দেখা যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে দুটো বিকল্প; একটি হলো এ কথা বলা যে, এখনো তার অস্তিত্ব আছে। আর অন্যটা হলো এ কথা বলা যে, আমরা যখন জর্জ ওয়াশিংটন শব্দ দুটি ব্যবহার করি তখন আসলে এই নামের কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে বলি না। উভয়ই কূটাভাসা বলে মনে হয়, তবে দ্বিতীয়টি একটু কম। যে-অর্থে দ্বিতীয়টি সত্য আমি তা দেখাবার চেষ্টা করব।
পারমিনাইডিস মনে করেন শব্দের স্থায়ী অর্থ থাকে। এ কথা আসলেই তার যুক্তির ভিত্তি এবং এই ভিত্তিকে তিনি প্রশ্নাতীত মনে করেন। কিন্তু একটি অভিধানে বা কোষগ্রন্থে একটি শব্দের যে-অর্থ থাকে-যাকে একটি শব্দের আনুষ্ঠানিক বা সামাজিকভাবে নির্ধারিত অর্থ বলা যেতে পারে-দুজন ব্যক্তি যখন সেই শব্দটি ব্যবহার করে তখন সেই একই ভাবনা তাদের মনের মধ্যে থাকে না।
জর্জ ওয়াশিংটন নিজে তার নাম ব্যবহার করতে পারতেন এবং তার সমার্থক হিসেবে আমি শব্দটি ব্যবহার করতে পারতেন। তিনি নিজের চিন্তাভাবনা ও দেহের নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। সুতরাং অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে তিনি অধিকতর পরিপূর্ণ অর্থে নিজের নাম ব্যবহার করতে পারতেন। তার উপস্থিতিতে তার বন্ধুরা তার দেহের নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করতে পারতেন এবং তার চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে ধারণা করতে বা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। তাদের কাছে জর্জ ওয়াশিংটন নামটির অর্থ তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে সুনির্দিষ্ট ছিল। তার মৃত্যুর পরে তার বন্ধুদের প্রত্যক্ষণের বিকল্প হিসেবে স্মৃতির শরণ নিতে হয়েছে, এবার তারা যখন তার নামটি ব্যবহার করেন তখন তাদের মানসিক প্রক্রিয়ায় একটি পরিবর্তন ঘটে। আমরা যারা জর্জ ওয়াশিংটনকে দেখিনি তাদের মানসিক প্রক্রিয়াটি কিন্তু তার বন্ধুদের মানসিক প্রক্রিয়ার চেয়ে ভিন্ন। আমরা তার ছবির কথা ভাবতে পারি এবং নিজেকে বলতে পারি হ্যাঁ, এই লোক। আমরা ভাবতে পারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। যদি আমরা খুবই অজ্ঞ হই তাহলে তার ছবি দেখে আমাদের মনে হবে, এই লোকটিকে জর্জ ওয়াশিংটন বলে ডাকা হতো। এই নামকে ঘিরে যা কিছুই আমরা বলি না কেন, তা এই নামের খোদ মানুষটি সম্পর্কে নয়, কারণ সেই মানুষটিকে আমরা কখনো দেখিনি বা জানি না, বরং তা এমন একটা কিছু যা আমাদের অনুভূতি, স্মৃতি বা চিন্তায় বিরাজমান। এর দ্বারা পারমিনাইডিসের যুক্তির ভ্রান্তিটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
শব্দের অর্থের এই নিরন্তর পরিবর্তন এই সত্য দ্বারা ঢাকা পড়ে যে, যে-বাক্যের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট শব্দ থাকে তার সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে ওই পরিবর্তনে কিছু এসে যায় না। আপনি যদি এমন একটি বাক্য বলেন যার মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটন শব্দটি রয়েছে, এবং ওই বাক্যে জর্জ ওয়াশিংটন-এর জায়গায় যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা হয়, তাহলেও বাক্যটি একই রকম সত্য থেকে যাবে। এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও অবশ্য রয়েছে। ওয়াশিংটন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার আগে একজন মানুষ বলতে পারতেন, আমি আশা করছি জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হবেন। কিন্তু তিনি বলবেন না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হবেন। কিন্তু এ ধরনের ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিয়ে একটি নিয়ম তৈরি করে নেওয়া যায় এবং অবশিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে শুধু জর্জ ওয়াশিংটনের জন্য প্রযোজ্য যেকোনো বাক্যে জর্জ ওয়াশিংটনের জায়গায় ওই শব্দগুলো ব্যবহার করা যায়। তার সম্বন্ধে আমরা যা জানি তা কেবল এ ধরনের বর্ণনাত্মক বাক্যের মাধ্যমে জানতে পারি।
পারমিনাইডিস মনে করেন, সাধারণভাবে অতীত বলতে যা বোঝানো হয় তা যেহেতু আমরা বর্তমান সময়ে জানতে পারি, তাই তা আসলে অতীত হতে পারে না, বরং কিছু অর্থে তা বর্তমান সময়েও অস্তিত্বমান। তাই তিনি মনে করেন পরিবর্তন বলে কিছু নেই। জর্জ ওয়াশিংটন সম্বন্ধে আমরা যা বলছি তা এই যুক্তিকে সমর্থন করে। এক অর্থে বলা যেতে পারে যে অতীত সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। যখন আমরা কোনো কিছু স্মরণ করি, স্মরণক্রিয়াটি ঘটে বর্তমান মুহূর্তে এবং আমাদের স্মরণ আর যে ঘটনাগুলো আমরা স্মরণ করছি সেগুলো এক জিনিস নয়। কিন্তু স্মরণক্রিয়ায় অতীতের ঘটনাবলির বর্ণনা করা হয়, আর বর্ণনা ও বর্ণিত ঘটনাবলির মধ্যে পার্থক্য করা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়। এই পুরো যুক্তিটি থেকে দেখা যাচ্ছে, ভাষা থেকে অধিবিদ্যক সিদ্ধান্তে পৌঁছা কত সহজ। এ থেকে আরো দেখা যায় যে, এ ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ যুক্তি এড়ানোর একমাত্র উপায় হিসেবে ভাষার যুক্তিশাস্ত্রীয় এবং মনস্ত ত্ত্বিক গবেষণা অগ্রসর হয়েছে, যা অধিকাংশ অধিবিদ্যক পণ্ডিত করেননি।
তবে আমার মনে হয়, পারমিনাইডিস যদি মৃত্যুলোক থেকে ফিরে আসতে পারতেন এবং আমি যেসব কথা বলছিলাম তা পাঠ করতেন, তাহলে তার কাছে এগুলো অত্যন্ত অগভীর, উপরভাষা বলে মনে হতো। তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি কীভাবে জানো যে জর্জ ওয়াশিংটন সম্পর্কে তোমার বক্তব্য একটি অতীত কাল সম্পর্কিত? তোমার নিজের বক্তব্য অনুসারেই প্রত্যক্ষ উল্লেখগুলো এমন সব বিষয় সম্পর্কে যেগুলো এই মুহূর্তে বর্তমান। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তোমার স্মৃতিচারণা ঘটছে এই মুহূর্তে তুমি যে সময়ের কথা স্মরণ করছ বলে তোমার মনে হচ্ছে সেই সময়ে নয়। স্মৃতিকে যদি জ্ঞানের একটি উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে মনের সামনে যে অতীত রয়েছে তা আসলে এই মুহূর্ত এবং সে কারণে কিছু অর্থে তা অবশ্যই এখনো অস্তিত্বমান।