পারমিনাইডিস তার তত্ত্বকে ভাগ করেছেন দুই ভাগে। যথা : সত্যের পথ এবং অভিমতের পথ। অভিমতের পথ নিয়ে এখানে আমাদের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। সত্যের পথ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন-তার যতটুকু আমাদের কাল পর্যন্ত টিকে আছে-তার মূল দিকগুলো এ রকম : যা নেই তাকে তুমি জানতে পারো না-সেটা অসম্ভব-তুমি তা উচ্চারণও করতে পারো না। কারণ কোনো কিছু সম্পর্কে চিন্তা করা মানেই সেটির অস্তিত্ব আছে।
তাহলে এটা কেমন করে হতে পারে যে, যা আছে তা ভবিষ্যতেও থাকবে? কীভাবে তা অস্তিত্ব লাভ করল? যদি তা অস্তিত্ব লাভ করে থাকে তাহলে তা নেই, ভবিষ্যতে যদি তা অস্তিত্ব লাভ করে তাহলেও তা নেই। তাহলে তো হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়া বিলুপ্ত হবে এবং গত হচ্ছে কথাটা শোনা যাবে না।
যে-জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করা যায় আর যে-জিনিসের কারণে চিন্তার অস্তিত্ব আছে তা একই। কারণ অস্তিত্বমান কোনো বস্তু ছাড়া তা সম্পর্কে উচ্চারিত কোনো চিন্তা হতে পারে না।
এই যুক্তির সারকথা হলো : যখন তুমি কিছু সম্পর্কে চিন্তা করো, অবশ্যই কোনো একটা বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করো; যখন তুমি একটা নাম ব্যবহার করো, অবশ্যই তা একটা-কিছুর নাম। সুতরাং চিন্তা ও ভাষা উভয়েরই এমন বিষয় প্রয়োজন যা থাকে চিন্তা ও ভাষার বাইরে। আর, একটি বস্তু সম্পর্কে যেকোনো সময় চিন্তা করা বা কথা বলা যায় মানে যে-বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করা বা কথা বলা যায় তার অস্তিত্ব সর্বদা বিরাজমান থাকে। তাহলে, পরিবর্তন বলে কিছু থাকতে পারে না, কেননা পরিবর্তন ঘটে কেবল সেইসব বস্তুর মধ্যে যা অস্তিত্ব লাভ করে এবং বিলুপ্ত হয়।
দর্শনে একটিই চিন্তা ও ভাষা থেকে সাধারণ জগতের ব্যাপারে যুক্তির প্রথম দৃষ্টান্ত। অবশ্য এই যুক্তিকে ন্যায্য বলে গ্রহণ করা যায় না, কিন্তু এতে সত্যের কী উপাদান রয়েছে তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। যুক্তিটি আমরা উপস্থাপন করতে পারি এভাবে : ভাষা যদি নিছক অর্থহীন না হয় তাহলে প্রতিটি শব্দের অবশ্যই কিছু অর্থ থাকতে হবে এবং সাধারণভাবে একটি শব্দের অর্থ দ্বারা অন্য একটি শব্দের অর্থ বোঝাবে না, বরং এমন একটা-কিছু বোঝাবে যার অস্তিত্ব আছে; আমরা তা সম্পর্কে কিছু বলি বা না বলি তার ওপরে সেটার অর্থ থাকা-না-থাকা নির্ভর করে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যাক, জর্জ ওয়াশিংটন সম্বন্ধে কিছু বলা হচ্ছে। এই নামে যদি কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তির অস্তিত্ব না থাকত তাহলে নামটি (মনে হবে) অর্থহীন হয়ে যেত এবং যেসব বাক্যে এই নামটি ব্যবহার করা হবে সেগুলোরও কোনো অর্থ দাঁড়াবে না। পারমিনাইডিস মনে করতেন, জর্জ ওয়াশিংটনের অস্তিত্ব কেবল অতীতেই ছিল তাহলে চলবে না, বর্তমানেও তাকে অবশ্যই থাকতে হবে, কেননা আমরা এখনো তার নামটি অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারি। এটাকে স্পষ্টতই অসত্য মনে হয়, কিন্তু যুক্তিটি আমরা এড়িয়ে যাব কীভাবে?
একজন কাল্পনিক ব্যক্তির কথা ধরা যাক, ধরা যাক হ্যামলেট। হ্যামলেট ডেনমার্কের রাজপুত্র ছিলেন-এই বিবৃতিটি বিবেচনা করা যাক। কথাটি কিছু অর্থে সত্য, কিন্তু ঐতিহাসিক অর্থে সত্য নয়। সত্য বিবৃতিটি হবে, শেক্সপিয়র বলেন যে হ্যামলেট ডেনমার্কের রাজপুত্র ছিলেন। বা আরো পরিষ্কারভাবে বললে, শেক্সপিয়র বলেন যে, ডেনমার্কে হ্যামলেট নামে এক রাজপুত্র ছিলেন। এখানে এখন আর কাল্পনিক কিছুই নেই। শেক্সপিয়র, ডেনমার্ক এবং হ্যামলেট শব্দটি-সবই বাস্তব। কিন্তু হ্যামলেট ধ্বনিটি বাস্তব কোনো নাম নয় কারণ হ্যামলেট বলে বাস্তবে কোনো মানুষকে ডাকা হয় না। যদি বলা হয়, হ্যামলেট একজন কাল্পনিক ব্যক্তির নাম-তাহলেও বাক্যটি কড়া অর্থে সঠিক হয় না। বলতে হবে কল্পনা করা হয় যে, হ্যামলেট একজন বাস্তব মানুষের নাম।
হ্যামলেট একজন কল্পিত মানুষ, একশৃঙ্গ প্রাণী (unicorn) একটি কল্পিত প্রজাতি। যেসব বাক্যে একশৃঙ্গ শব্দটি থাকবে সেগুলোর কিছু সত্য হবে, কিছু ভ্রান্ত হবে-কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষভাবে সত্য বা ভ্রান্ত হবে না। এই দুটি বাক্য বিবেচনা করা যাক: একটি একশৃঙ্গ প্রাণীর একটি শিং থাকে এবং একটি গরুর দুটি শিং থাকে। দ্বিতীয় বাক্যটির সত্যতার জন্য আপনাকে একটি গরুর দিকে তাকাতে হবে, এ ক্ষেত্রে এ কথা বলাই যথেষ্ট হবে না যে, কিছু কিছু বইতে বলা হয়েছে যে, গরুর দুটি শিং থাকে। কিন্তু একশৃঙ্গ প্রাণীর একটি শিং থাকে-এই বিবৃতির সাক্ষ্য শুধু বইতেই পাওয়া যাবে। আসলে এ ক্ষেত্রে সঠিক বিবৃতিটি হবে, কিছু কিছু বইতে বলা হয়েছে যে, এক শিংবিশিষ্ট এক জাতীয় প্রাণী আছে যাদেরকে একশৃঙ্গ প্রাণী বলা হয়। একশৃঙ্গ সম্বন্ধে সব বাক্যই প্রকৃতপক্ষে একশৃঙ্গ শব্দটির সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনো প্রাণীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ঠিক একইভাবে হ্যামলেট সম্বন্ধে সব কথাই বস্তুত হ্যামলেট শব্দটির সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনো মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা কথা বলি শব্দ সম্পর্কে নয়, বরং শব্দটি দ্বারা যা বোঝায় তা সম্পর্কে। এটাই আমাদেরকে পারমিনাইডিসের যুক্তির কাছে নিয়ে যায়। আর তা হলো, যদি কোনো শব্দ অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহৃত হতে পারে তাহলে সেই শব্দ দ্বারা অবশ্যই একটা কিছু বোঝায়, কিছুই বোঝায় না। তা হয় না। সুতরাং সেই শব্দ দ্বারা যা বোঝায়, কিছু অর্থে তার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে।