পরিবর্তনের প্রতি সমুদয় বিশ্বাস সত্ত্বেও হেরাক্লিটাস নিজে মনে করতেন, একটি কিছু আছে যা চিরস্থায়ী। শাশ্বতের ধারণা (অসীম স্থিতিকালের বিপরীত হিসেবে) এসেছে পারমিনাইডিস থেকে; হেরাক্লিটাসে তা দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তার দর্শনে কেন্দ্রীয় আগুনটি কখনোই নেভে না : বিশ্ব সর্বদা এক চিরঞ্জীব আগুন ছিল, আছে এবং চিরকাল থাকবে। কিন্তু আগুন অবিরামভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তার স্থায়িত্ব কোনো বস্তুর স্থায়িত্ব নয়, বরং একটি প্রক্রিয়ার স্থায়িত্ব-যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গি হেরাক্লিটাসের নয়।
দর্শনের মতো বিজ্ঞানও পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চের মধ্যে কিছু স্থায়ী অধঃস্তর অন্বেষণের মাধ্যমে নিরন্তর পরিবর্তনের তত্ত্বটি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। এই আকাক্ষা রসায়নশাস্ত্রের দ্বারা পূরণ হয়েছিল বলে মনে হয়। দেখা গেছে, আগুন আপাতদৃষ্টিতে নিভে গেলেও বস্তুতপক্ষে ধ্বংস হয় না, রূপান্তরিত হয় : উপাদানগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটে, কিন্তু সেই বিন্যাসের আগে যেসব পরমাণু ছিল পুনর্বিন্যাস-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার পরেও সেগুলোর প্রত্যেকটি থেকে যায়। সে অনুসারে ধারণা করা হয়েছিল যে, পরমাণু ধ্বংসযোগ্য নয় এবং বস্তুজগতে সব পরিবর্তন আসলে স্থায়ী উপাদানগুলোর পুনর্বিন্যাস মাত্র। তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত এই মত চালু ছিল, কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হবার পরে জানা গেল, পরমাণু বিভাজিত হতে পারে।
অদম্য পদার্থবিজ্ঞানীরা নতুন নতুন এবং ক্ষুদ্রতর একক আবিষ্কার করলেন, সেগুলোকে বলা হয় ইলেকট্রন ও প্রোটন-এদের সমন্বয়েই পরমাণু গঠিত। কিছুকাল ধরে এমন ধারণা চালু ছিল যে, এই এককগুলো অবিভাজ্য, যেমন আগে পরমাণুর ক্ষেত্রে মনে করা হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা গেল, প্রোটন ও ইলেকট্রন মিলিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এবং তা থেকে নতুন বস্তু উৎপন্ন হয় না, বরং বিশ্বব্যাপী এমন এক শক্তি সঞ্চারিত হয় যার বেগ আলোর বেগের সমান। স্থায়ী একটি কিছু হিসেবে বস্তুর জায়গা দিতে হয়েছে শক্তিকে। কিন্তু শক্তি বস্তুর মতো নয়, একটি জিনিস সম্পর্কে কোনো সাধারণ-জ্ঞানপ্রসূত ধারণা নয়। বরং শক্তি ভৌত প্রক্রিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। ব্যাপারটাকে হেরাক্লিটাসের আগুনের মতো মনে করা যেতে পারে, কিন্তু তা দহনের একটি প্রক্রিয়া, দাহ্য বস্তু নয়। যা দাহ্য তা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতরের দিকে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান মহাশূন্যের পদার্থগুলোকে চিরস্থায়ী ভাবার কোনো সুযোগ রাখেনি। গ্রহগুলো বেরিয়ে এসেছে সূর্য থেকে, আর সূর্যের উৎপত্তি নীহারিকা থেকে। সূর্য কিছুকাল ধরে আছে, আরো কিছুকাল থাকবে, কিন্তু একদিন না একদিন-হয়তো কোটি কোটি বছর পরে-তা বিস্ফোরিত হবে এবং সেই সঙ্গে সব গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্তত এমনটাই বলেন। সেই চরম লগ্ন এগিয়ে আসতে আসতে একদিন তারা হয়তো দেখতে পাবেন যে তাদের হিসাব-নিকাশে ভুল-ত্রুটি আছে। হেরাক্লিটাসের নিরন্তর পরিবর্তনের মতবাদটি বেদনাদায়ক এবং আমরা দেখেছি, একে খারিজ করে দিতে বিজ্ঞান কিছুই করতে পারে না। বিজ্ঞান যেসব আশাকে হত্যা করেছে সেগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা দার্শনিকদের অন্যতম প্রধান আকাঙ্ক্ষা। তাই দার্শনিকরা এমন কিছুর অন্বেষণ করেছেন যা কালের রাজত্বের অধীনে নয়। এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে পারমিনাইডিসের হাতে।