সন্দেহ নেই যে হেরাক্লিটাসের ঈশ্বর তার মহাজাগতিক ন্যায্যতার ধারণাটির মূর্ত প্রকাশ। সবকিছুই পরিবর্তনশীল অবস্থায় বিরাজমান-এই তত্ত্বটি হেরাক্লিটাসের তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। প্লেটোর থিয়াটিটাস-এর বর্ণনা অনুসারে এই তত্ত্বটির ওপরেই হেরাক্লিটাসের অনুসারীগণ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন। তুমি এক নদীতে দুবার পা ফেলতে পারবে না কারণ তোমার উপর দিয়ে সর্বদাই নতুন জল প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি দিনের সূর্যই নতুন।
সাধারণভাবে মনে করা হয়, সার্বিক পরিবর্তনে বিশ্বাসের বিষয়টির প্রকাশ ঘটেছে হেরাক্লিটাসের এই বাক্যে : সব বস্তুই বহমান। কিন্তু তিনি যে এই বাক্যটি সত্যই বলেছিলেন তার কোনো প্রমাণ নেই, যেমন প্রমাণ নেই যে ওয়াশিংটন বলেছিলেন, বাবা, আমি তো মিথ্যে বলতে পারি না এবং অয়েলিংটন বলেছিলেন, সৈন্যরা ওঠো এবং আক্রমণ করো।
প্লেটোর পূর্ববর্তী সব দার্শনিকের বক্তব্য সম্পর্কে জানা যায় বিভিন্ন উদ্ধৃতি থেকে। সে উদ্ধৃতিগুলোর বেশিরভাগই প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের দেওয়া, দার্শনিকদের বক্তব্যগুলো খণ্ডন করার প্রয়োজনে তারা উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছেন। হেরাক্লিটাসের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। তার বক্তব্য সম্পর্কেও জানা যায় উদ্ধৃতি থেকে। আধুনিক কোনো দার্শনিককে জানার একমাত্র উৎস যদি হতো তার শত্রুদের বাদানুবাদ, তাহলে তার অবস্থাটা কী দাঁড়াত সে কথা ভাবলে দেখা যাবে সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিক দার্শনিকরা কতই না প্রশংসনীয়, তাদের শত্রুদের ছড়ানো সব প্রতিহিংসার পরেও তারা যথেষ্ট মহৎ বলে প্রতিভাত হবেন। সে যাই হোক না কেন, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল একমত যে হেরাক্লিটাসের শিক্ষা ছিল : কোনো কিছুরই অস্তিত্ব সম্পূর্ণ হয়নি, সবকিছুই অস্তিত্বলাভের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। (প্লেটো) এবং কোনো কিছুই অপরিবর্তিতরূপে বিরাজমান নয়। (অ্যারিস্টটল)।
এই তত্ত্বের আলোচনায় আবার ফিরে আসা যাবে প্লেটো সম্পর্কিত আলোচনার সময়। প্লেটো এই তত্ত্বটি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন। দার্শনিকগণ এই তত্ত্বের ব্যাপার কী বলেছেন সে অনুসন্ধানে আপাতত না গিয়ে আমরা দেখার চেষ্টা করব এ সম্পর্কে কবিদের অনুভূতি কী এবং বিজ্ঞানের লোকজন এ ব্যাপারে কী বলেছেন।
যেসব সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে মানুষ দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গভীর প্রবৃত্তিগুলোর একটি হচ্ছে স্থায়ী একটি-কিছুর আকাঙ্ক্ষা বা অনুসন্ধান। সন্দেহ নেই যে এ প্রবৃত্তির উৎস গৃহের প্রতি ভালোবাসা এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষা। তাই দেখা যায়, এই প্রবৃত্তি সেই সব মানুষের মধ্যে বেশি তীব্র, যাদের জীবনযাপন বিপদসঙ্কুল পরিবেশে। ধর্ম স্থায়িত্বের অন্বেষণ করে দুই ভাবে : ঈশ্বরের মধ্যে অমরত্বে। ঈশ্বরে অস্থিরতার বা পরিবর্তনশীলতার ছায়ামাত্র নেই; আর মৃত্যুর পরবর্তী জীবন চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর হাসি-খুশি মনোভাব মানুষকে এসব অনড় ধারণাগুলোর প্রতি বিমুখ করে তোলে। আধুনিক উদারপন্থী ধর্মতত্ত্ব বিশ্বাস করে যে স্বর্গেও প্রগতি আছে এবং ঈশ্বরের মাথায়ও চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটছে। কিন্তু এসব ধারণার মধ্যেও স্থায়ী কিছু আছে, যথা খোদ প্রগতিকে এবং তার সর্বব্যাপী গন্তব্যকে মনে করা হচ্ছে স্থায়ী। আবার এক নিমেষের বিপর্যয়েই মানুষ ফিরে যায় তার পুরোনো অপার্থিব জগতে, সব আশা-ভরসা ন্যস্ত করে তারই ওপর। সে বলে, এই পৃথিবীতে জীবন যদি হতাশায় ভরে ওঠে তাহলে কেবল স্বর্গেই শান্তির সন্ধান করা যায়। যা কিছু মানুষের প্রিয় তার সবই হরণ করে নিয়ে যায় কাল-এই নিয়ে কতই না অনুশোনা করেছেন কবিরা।
যৌবনের উদ্দামতাকে বিদ্ধ করে কাল
আর সুন্দরের কপালে এঁকে দেয় বলিরেখা
প্রকৃতির দুর্লভ সত্য কালের আহার
কালের কাস্তে কচুকাটা করবে সব-রবে না কিছুই।
তবে সেইসঙ্গে তারা সাধারণত বলেন যে তাদের কাব্যগুলো অমর–
তবুও, কালের কাছে প্রত্যাশা, আমার কবিতা রবে।
থাক না তার নিষ্ঠুর হাত, আমি গাইব তোমার মহিমা।
যা কিছু কালের মধ্যে বিরাজমান তা ক্ষণস্থায়ী–এ কথা প্রত্যাখ্যান করতে না পেরে দার্শনিকতাপ্রবণ মরমিবাদীগণ শাশ্বতের এক ধারণা উদ্ভাবন করেছেন- শাশ্বত সীমাহীন কালব্যাপী বিরাজমান কিছু নয়, বরং কাল-প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বাইরের একটি অস্তিত্ব। কিছু কিছু ধর্মতাত্ত্বিকের মতে, উদাহরণস্বরূপ ডিন ইঙ্গের মতে, শাশ্বত জীবন বলতে ভবিষ্যৎকালের প্রতিটি মুহূর্তজুড়ে অস্তিত্ব বোঝায় না, বরং তারা সম্পূর্ণরূপে সময়নিরপেক্ষ সত্তার একটি অবস্থা, যেখানে আগে বা পরে বলে কিছু নেই এবং সে কারণে পরিবর্তনে কোনো যৌক্তিক সম্ভাবনা নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি কাব্যিকভাবে প্রকাশ করেছেন ভগান
সে-রাতে আমি শাশ্বতকে দেখেছি
বিশুদ্ধ আর অনিঃশেষ আলোকের এক বলয় যেন
শান্ত আর উজ্জ্বল
আর নিচে তাকে ঘিরে প্রহর, দিবস, বর্ষ
গোলক-তাড়িত
যেন এক বিপুল ছায়া চলমান
তাতে নিক্ষিপ্ত বিশ্ব ও তার সর্বস্ব।
দর্শনের সুবিখ্যাত কয়েকটি তত্ত্বে এই ধারণাটিই পরিমিত গদ্যে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং ধৈর্যসহকারে যুক্তি অনুসরণ করলে আমরা তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হব।