হাডেস-এ আত্মার গন্ধ পাওয়া যায়। মহত্তর মৃত্যু বৃহত্তর ভাগ লাভ করে (যারা এমন মৃত্যুবরণ করে তারা দেবতায় পরিণত হয়)। নিশাচর, জাদুকর, বাক্কাসের পুরোহিত এবং মদ-ভাটির যাজিকারা গুহ্য বিষয়াদির কারবারি। লোকেরা যেসব গুহ্যাচারের চর্চা করে সেগুলো অপবিত্র গুহ্যাচার। আর তারা এমনভাবে এসব ছবিকে উপাসনা করে, যেন-বা তারা মানুষের ঘরবাড়ির সঙ্গে কথা বলছে। তারা জানে না, দেবতা ও বীদের স্বরূপ কী। কারণ তারা ডায়োনিসাসের পানে শোভাযাত্রা করে আর লজ্জাকর লিঙ্গাত্মক স্তোত্ৰগীত গায়, তা যদি তারা নাও করত, তার চেয়েও লজ্জাজনক আচরণ তারা করত নিশ্চয়। কিন্তু ডায়োনিসাস আর হাডেস অভিন্ন, অথচ তারা সেই ডায়োনিসাসের জন্যই পাগল হয়, মদের ভঁটি ঘিরে ভোজনোৎসবে মেতে ওঠে। তারা রক্ত মেখে বৃথাই নিজেদের পবিত্র করার চেষ্টা করে, ঠিক যেন কেউ কাদার মধ্যে পা দিয়ে কাদায় পা ধুয়ে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করছে। কাউকে এভাবে কাদায় পা ধুতে দেখলে মানুষ তাকে পাগল ঠাওরায়।
হেরাক্লিটাস মনে করতেন আদি উপাদান হচ্ছে আগুন। আগুন থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে। পাঠকের মনে পড়বে, থেলিস মনে করতেন সবকিছুর সৃষ্টি পানি থেকে। অ্যানাক্সিমেনিস মনে করতেন আদি উপাদান বায়ু। আর হেরাক্লিটাসের বিশ্বাস ছিল আদি উপাদান আগুন। অবশেষে রাষ্ট্রনায়কোচিত একটি সমঝোতা পাওয়া যায় এম্পিডক্লিসের কাছ থেকে। তিনি মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি-এই চার উপাদানকেই স্বীকৃতি দেন। এই পর্যায়ে এসে প্রাচীন রসায়নশাস্ত্র থেমে দাঁড়ায়। যত দিন পর্যন্ত না মুসলমান আলকেমিস্টরা পরশমণি, অমরত্ব-সুধা আর নিকৃষ্ট ধাতুকে সোনায় পরিণত করার পদ্ধতি অনুসন্ধান আরম্ভ করেছেন, তত দিন পর্যন্ত রসায়নশাস্ত্রের আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
হেরাক্লিটাসের অধিবিদ্যা এমন গতিশীল যে তা অত্যুৎসাহী আধুনিক ব্যক্তিদেরও বেশ সন্তুষ্ট করতে পারে : এই জগৎ, যা কিনা সবার কাছে অভিন্ন, তা মানুষ-দেবতা কারোর দ্বারাই সৃষ্ট নয়। বরং তা সদা বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে, এ এক চিরজ্বলন্ত আগুন, ক্ষণে জ্বলছে, ক্ষণে নিভছে। আগুন প্রথমে রূপান্তরিত হয় সমুদ্রে, আর সমুদ্রের অর্ধেক মাটি, অর্ধেক ঘূর্ণিবায়ু। এ রকম জগতে নিরন্তর পরিবর্তনই প্রত্যাশিত। হেরাক্লিটাস এই নিরন্তর পরিবর্তনেই বিশ্বাসী ছিলেন। তবে তার আরো একটি তত্ত্ব ছিল। সেটিকে তিনি পরিবর্তনের তত্ত্বের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতেন। তত্ত্বটি ছিল বিপরীত বস্তুগুলোর মিলনের তত্ত্ব। হেরাক্লিটাস বলেন, মানুষ জানে না বিরোধপূর্ণ ব্যাপারগুলোর মধ্যে সমঝোতা ঘটে কীভাবে। এটা আসলে বিপরীতমুখী চাপগুলোর ঐক্যাবিধান-ধনুক ও বীণার মতো। দ্বন্দ্বের প্রতি হেরাক্লিটাসের বিশ্বাস এই তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত; দ্বন্দ্বের মধ্যে বিপরীতগুলোর মিলনের ফলে একটি গতির সৃষ্টি হয়, যা কিনা একটি ছন্দ। জগতে একটি ঐক্য আছে, কিন্তু সে ঐক্য বৈচিত্র্যের ফল : জোড় বস্তুগুলো একইসঙ্গে সমগ্র, আবার সমগ্র নয়। একত্রিত, আবার বিচ্ছিন্ন। বৈরিতামুক্ত, আবার বিরোধপূর্ণ। সব বস্তু মিলে একের সৃষ্টি, আবার সব বস্তুর উৎপত্তি এক থেকে।
কখনো কখনো হেরাক্লিটাসের বক্তব্য থেকে মনে হবে ঐক্য বৈচিত্র্যের চেয়ে অধিকতর মৌলিক : শুভ ও অশুভ এক। ঈশ্বরের কাছে সবকিছুই সুন্দর, শুভ ও ন্যায্য। কিন্তু মানুষ কিছু জিনিসকে ন্যায্য আর কিছু জিনিসকে অন্যায্য মনে করে। ঊর্ধ্বমুখী পথ আর নিম্নমুখী পথ এক এবং অভিন্ন। ঈশ্বর হলেন রাত ও দিন, শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল, যুদ্ধ ও শান্তি, অরুচি (অতিপানভোজনের ফলে) ও ক্ষুধা। কিন্তু তিনি বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেন। ঠিক আগুনের মতো; আগুনের সঙ্গে মসলা মেশালে সে মসলার স্বাদ-গন্ধ অনুসারে নাম হয় সে আগুনের। তবুও, মিলিত হবার মতো বৈপরীত্য না থাকলে কোনো ঐক্য সম্ভব হতো না : আমাদের জন্য যা ভালো তা হচ্ছে বৈপরীত্য।
হেরাক্লিটাসের এই তত্ত্বে হেগেলের দর্শনের বীজাণু রয়েছে। হেগেলের দর্শন অগ্রসর হয়েছে বিপরীতগুলোর সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। অ্যানাক্সিমেন্ডারের অধিবিদ্যার মতো হেরাক্লিটাসের অধিবিদ্যায়ও মহাজাগতিক ন্যায়বিচারের একটি ধারণার প্রাধান্য রয়েছে। মহাবিশ্বে এমন একটি ন্যায়বিচার আছে যার ফলে বিপরীতগুলোর দ্বন্দ্বে কোনো পক্ষই কখনো চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারে না।
সব বস্তুই আগুনের বিনিময় আর আগুন সবকিছুর বিনিময়, যেমনটি সোনার বিনিময়ে সবকিছু পাওয়া যায়, আর সবকিছুর বিনিময়ে সোনা পাওয়া যায়। আগুন জীবন লাভ করে বাতাসের মৃত্যুতে, আর বাতাস বেঁচে থাকে আগুনের মৃত্যুতে। মাটির মৃত্যু হচ্ছে পানির জীবন, আর মাটির জীবন হচ্ছে পানির মৃত্যু। সূর্য অতিক্রম করবে না তার সীমারেখা। যদি করে, তাহলে এরিনাইসরা-ন্যায়ের পরিচারিকারা-ধরে ফেলবে তাকে। আমাদের জানা থাকা দরকার যে সবকিছুর মধ্যেই যুদ্ধ চলছে। দ্বন্দ্বই ন্যায্য।
হেরাক্লিটাসে বারবার যে ঈশ্বরের কথা পাওয়া যায়, সে ঈশ্বর দেবতাদের থেকে আলাদা। মানুষের পথে কোনো প্রজ্ঞা নেই, কিন্তু ঈশ্বরের পথে প্রজ্ঞা আছে…ঈশ্বর মানুষকে বলেন বাছা, এমনকি মানুষ মানুষকে বলে শিশু…সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটিও ঈশ্বরের তুলনায় উলুক, ঠিক যেমন সবচেয়ে সুন্দর উলুকটিও মানুষের তুলনায় কুৎসিত।