পৃথিবী ছিল স্ত্রী, সূর্য পুরুষ। ষাঁড় গরুকে সাধারণত পুরুষ উর্বতার মূর্ত প্রকাশ বলে মনে করা হতো; সর্বত্রই ষাঁড়-দেবতার দেখা পাওয়া যেত। ব্যাবিলনে স্ত্রী দেবতাদের মধ্যে মৃত্তিকা দেবী ইশতারের স্থান ও মর্যাদা ছিল সবার উপরে। পশ্চিম এশিয়াজুড়ে এই মহামাতার পূজা করা হত বিভিন্ন নামে। গ্রিক ঔপনিবেশিক শাসকরা এশিয়া মাইনরে যখন ইশতারের মন্দিরগুলো দেখতে পায় তখন তারা তার নাম দেয় আরটেমিস এবং তারা সেখানকার বিদ্যমান ধর্ম গ্রহণ করে। ডায়ানা অব এফেসিয়ানস-এর আদি উৎস ছিল এটাই। খ্রিস্ট ধর্ম তাকে রূপান্তরিত করে কুমারী মেরিতে। এফেসাসে একটি পরিষদ ছিল যারা আমাদের লেডির (যিশুমাতা মেরিকে বোঝানো হচ্ছে) ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ঈশ্বরমাতা অভিধানটিকে বৈধতা দান করে। যেখানে কোনো সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ধর্ম খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল সেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের আদিরূপ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সেখানে দেবতা বা দেবী রাষ্ট্রের সহযোগী হয়ে উঠেছে এবং তারা যে কেবল প্রচুর পরিমাণে ফসল ফলানোর ব্যবস্থা করত তা-ই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা বিজয় নিশ্চিত করত। একটি ধনী পুরাহিত সম্প্রদায় নীতি-আচার ও ধর্মকে বিশদভাবে প্রণয়ন করে সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সেগুলোকে একটি দেবতামণ্ডলীর সঙ্গে মিলিয়ে নিত।
রাজ্যশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে দেবতারা নৈতিকতার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট হতো। বিধানদাতারা বলত, তারা তাদের বিধানগুলো পেয়েছে দেবতার কাছ থেকে। তাই তারা দাবি করত, সাম্রাজ্যের আইন বা বিধান হচ্ছে ঐশ্বরিক, পবিত্র জিনিস। তাই সে-আইন ভঙ্গ করা পাপ। আজ পর্যন্ত জানা দণ্ডবিধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হচ্ছে ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি (খ্রি.পূ. ২০৬৭-২০২৫)-এর দণ্ডবিধি। রাজা হাম্মুরাবি দাবি করতেন দেবতা মারডক তাকে ওই দণ্ডবিধিটি দান করেছিল। প্রাচীনকালজুড়ে ধর্ম ও নৈতিকতার মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে।
মিসরীয় ধর্মে পরকালের চিন্তা প্রধান। কিন্তু ব্যাবিলনিয়ার পরকাল নয়, ইহকালের সুখ-সমৃদ্ধির কথাই বেশি ভাবা হতো। জাদু, তন্ত্রমন্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে বেশি উন্নত ছিল ব্যাবিলনিয়াতে এবং প্রধানত ব্যাবিলনের মাধ্যমেই এই জিনিসগুলো পরবর্তী প্রাচীন যুগে প্রাধান্য লাভ করেছিল। ব্যাবিলন থেকে কিছু জিনিস এসেছে যেগুলো বিজ্ঞানের অন্তর্গত। যেমন-দিন-রাত্রিকে ২৪ ঘণ্টায় ভাগ করা, বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করা ব্যাবিলনেই আবিষ্কৃত হয়। সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের বেলায় তারা একটি চক্র আবিষ্কার করে, যার ভিত্তিতে নিশ্চয়তার সঙ্গে চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়া যেত এবং সূর্যগ্রহণের সম্ভাব্যতা নির্দেশ করা যেত। দেখা যায়, পরবর্তীকালে থেলিস এই ব্যাবিলনীয় জ্ঞান আয়ত্ত করেছিলেন।
মিসর ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাগুলো ছিল কৃষিভিত্তিক এবং তার চারপাশের জাতিগুলোর সভ্যতা ছিল মূলত পশুপালনভিত্তিক। বাণিজ্য-প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়, প্রথমে বাণিজ্য ছিল পুরোপুরি সমুদ্রভিত্তিক। খ্রিস্টপূর্ব প্রায়। ১০০০ সাল পর্যন্ত অস্ত্রশস্ত্র ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি। যেসব জাতির নিজ নিজ অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধাতু ছিল না তারা তা সংগ্রহ করত হয় বাণিজ্য, নয় দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে। দস্যুবৃত্তি ছিল একটি সাময়িক কূটকৌশল। যেসব স্থানে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল সেখানে বাণিজ্য অধিকতর লাভজনক হয়ে ওঠে। বাণিজ্যক্ষেত্রে ক্রিটি দ্বীপ ছিল অগ্রপথিক। খ্রি.পূ. ২৫০০ থেকে খ্রি.পূ. ১৪০০ সাল পর্যন্ত এগারো শতাব্দী ধরে ক্রিটি দ্বীপে এক উন্নত শিল্পসভ্যতা ছিল, ইতিহাসে তা মিনোয়ান সভ্যতা (Minoan Civilization) নামে খ্যাত। ক্রিটীয় শিল্প-সংস্কৃতির যা কিছু আমাদের কাল অবধি টিকে রয়েছে তার নিদর্শনগুলো থেকে তাদের আনন্দোচ্ছল, এমনকি বেশ বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপনের ইঙ্গিত মেলে, যা মিসরীয় মন্দিরগুলোর ভয়গম্ভীর চেহারা থেকে খুবই আলাদা।
স্যার আর্থার ইভান্স ও অন্যদের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের আগ পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা ছিল না। এটি ছিল একটি সমুদ্র-উপকূলীয় সভ্যতা। হিসোসদের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত এই সভ্যতার সঙ্গে মিসরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মিসরীয় চিত্রাবলি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় মিসর ও ক্রিটি দ্বীপের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল, ক্রিটীয় নাবিকদের মাধ্যমে তা চলত। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম বিকাশ ঘটেছিল। মনে হয় ধর্মের দিক থেকে ক্রিটির সাদৃশ্য ছিল সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের সঙ্গে, আর শিল্পকলার দিক থেকে মিসরের সঙ্গে, যদিও ক্রিটির শিল্পকলা ছিল খুব মৌলিক ধরনের, তাতে চমৎকার জীবনবাদিতা ছিল। ক্রিটির সভ্যতার কেন্দ্রে ছিল তথাকথিত মিনোসের প্রাসাদ বা Palace of Minos। তার অবস্থান ছিল নসস (Knosos) নামক স্থানে। ক্রিটির প্রাসাদগুলো ছিল খুবই মনোমুগ্ধকর। সম্ভবত খ্রি.পূ. ১৪০০ শতাব্দীতে গ্রিক আগ্রাসীদের হাতে সেগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ক্রিটির ইতিহাসের কালপঞ্জি পাওয়া যায় মিসরে আবিষ্কৃত ক্রিটির জিনিসপত্র থেকে। এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আগাগোড়াই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর ওপর নির্ভরশীল।