পানি বা অন্য কোনো পরিচিত পদার্থ যে আদিবস্তু নয় তা প্রমাণ করার জন্য অ্যানাক্সিমেন্ডার এক তর্ক জুড়েছিলেন। সেটা ছিল এ রকম : উপাদানগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি যদি হয় আদি বা প্রাথমিক, তাহলে তা অন্যগুলোকে আত্মসাৎ করে নিত। অ্যারিস্টটল জানাচ্ছেন অ্যানাক্সিমেন্ডার বলেছিলেন, আমাদের পরিচিত বা জ্ঞাত পদার্থগুলো পরস্পর বিপরীতধর্মী। বায়ু শীতল, পানি আর্দ্র, আগুন গরম। অতএব, এদের যেকোনো একটি যদি অসীম হতো তাহলে এত দিনে অন্যগুলোর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যেত। সুতরাং এই মহাজাগতিক দ্বন্দ্বে আদি বস্তু অবশ্যই নিরপেক্ষ।
শাশ্বত এক গতি ছিল, জগৎগুলোর সূচনা ঘটেছে তারই ধারায়। জগৎগুলো সৃষ্টি হয়নি-খ্রিস্টীয় বা ইহুদি ধর্মতত্ত্বে যেমনটি বলা হয়েছে-বরং বিকশিত হতে হতে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। প্রাণিজগতে একটি বিকাশ প্রক্রিয়া ছিল। আর্দ্র উপাদান যখন সূর্যকিরণে বাষ্পীভূত হয়েছিল তখন তা থেকে প্রাণীগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। অন্য সব প্রাণীর মতো মানুষও সম্ভূত হয়েছে মাছ থেকে। নিশ্চয়ই ভিন্ন প্রকৃতির জীব থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে, কারণ এখন তার শৈশবকাল এত দীর্ঘ যে, আদিতে এ রকম থাকলে সে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারত না।
অ্যানাক্সিমেন্ডারের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ছিল প্রভূত পরিমাণে। বলা হয়, তিনিই সর্বপ্রথম একটি মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন পৃথিবীর আকৃতি একটি চোঙের মতো। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয় যে তিনি মনে করতেন সূর্য পৃথিবীর সমান বা পৃথিবীর চেয়ে ২৭ বা ২৮ গুণ বড়। তার মৌলিকত্ব ছিল তার বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদিতা।
অ্যানাক্সিমেনিস ছিলেন মিলেসীয় ধারার শেষ দার্শনিক। অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতো তিনি আগ্রহব্যঞ্জক না হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। তার জন্ম মৃত্যুর সাল-তারিখ খুবই অনিশ্চিত, তবে এটা নিশ্চিত যে তিনি ছিলেন অ্যানাক্সিমেন্ডারের পরবর্তীকালের। আর যেহেতু ৪৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আয়োনীয়দের বিদ্রোহ দমনের একপর্যায়ে পারসিকদের দ্বারা মিলেটাস বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেহেতু অ্যানাক্সিমেনিস নিশ্চিতভাবেই ওই সময়ের পূর্ববর্তী ছিলেন।
অ্যানাক্সিমেনিস বলেছিলেন মূল পদার্থ হচ্ছে বায়ু। আত্মা বায়ু, আগুন তরলীকৃত বায়ু। ঘনীভূত করা হলে বায়ু প্রথমে হয় পানি, তারপর আরো ঘনীভূত করা হলে হয় মাটি, এভাবে শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় পাথরে। এই তত্ত্বের মধ্যে যে কৃতিত্বটা আছে তা হচ্ছে শুধু বিভিন্ন পদার্থের ঘনীভবনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে তাদের মধ্যকার সব পার্থক্যকে পরিমাণগত রূপ দেওয়ার ক্ষমতা। তিনি মনে করতেন, পৃথিবীর আকৃতি একটি গোলাকার টেবিলের মতো, আর সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে বায়ু। আত্মা যেমন করে আমাদেরকে সংহত করে, একত্রে ধরে রাখে, তেমনি করে নিঃশ্বাস আর বায়ু পুরো বিশ্বকে ধরে রাখে। যেনবা পৃথিবী দম নিচ্ছে, দম ফেলছে।
প্রাচীন যুগে অ্যানাক্সিমেন্ডারের চেয়ে অ্যানাক্সিমেনিস বেশি সমাদৃত ছিলেন। অবশ্য আধুনিক দুনিয়ার যেকোনো মানুষ এখন এর ঠিক উলটো মূল্যায়নটাই করবে। পিথাগোরাস এবং তার পরবর্তী কালের অনেক চিন্তায় অ্যানাক্সিমেনিসের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। পিথাগোরাসবাদীরা আবিষ্কার করে পৃথিবী গোলাকার। কিন্তু পরমাণুবাদীরা ছিলেন অ্যানাক্সিমেনিসের মতের কাছাকাছি-অর্থাৎ পৃথিবী একটি চাকতির মতো।
মিলেসীয় দার্শনিক ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ তার অর্জনের কারণে নয়, বরং তার উদ্যম ও প্রয়াসের জন্য। মিলেসীয় ধারার উৎপত্তি ঘটেছিল ব্যাবিলনিয়া ও মিসরের সঙ্গে গ্রিক মননের সংযোগের ফলে। মিলেটাস ছিল একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক নগরী, যেখানে আদিম ধারণা ও কুসংস্কারগুলো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নমনীয় রূপ লাভ করেছিল। পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে দারিয়ুস কর্তৃক অধিকৃত হবার পূর্ব পর্যন্ত হেলেনিক জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আয়োনিয়া। ডায়োনিসাস এবং অর্ফিয়ুসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধর্মীয় আন্দোলনের স্পর্শ থেকে আয়োনিয়া প্রায় সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। আয়োনিয়ার ধর্ম ছিল অলিম্পীয়, তবে হয়তো ততটা কঠিন অর্থে নয়। থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার এবং অ্যানাক্সিমেনিসের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে বিবেচনা করতে হবে বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসেবে; সেগুলোতে প্রাণী বা বস্তুর মধ্যে মনুষ্যত্ব আরোপের আকাক্ষা, বা নৈতিক কোনো ধারণার অন্যায় অনুপ্রবেশ ছিল না। তাদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো ছিল উত্তম প্রশ্ন, আর তাদের প্রাণশক্তি অনুপ্রাণিত করেছিল পরবর্তীকালের অনুসন্ধিৎসুদের।
গ্রিক দর্শনের পরবর্তী ধাপ, যা দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা অধিকতর ধর্মীয় এবং বিশেষ করে, অধিকতর অর্ফিক। কিছু দিক থেকে তা বেশি আগ্রহব্যঞ্জক, অর্জনের দিক থেকে প্রশংসনীয়, কিন্তু মিলেটাসের দার্শনিক ধারার চেয়ে চেতনার দিক থেকে কম বিজ্ঞানভিত্তিক।
০৩. পিথাগোরাস
এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় প্রাচীন ও মধ্যযুগে পিথাগোরাসের প্রভাব। পিথাগোরাস ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মানবজাতির এ যাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন। জ্ঞানী লোক হিসেবে তো বটেই, এমনকি যখন তার আচরণে নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ পেয়েছে তখনো তিনি গুরুত্বপূর্ণ। প্রদর্শনমূলক অবরোহী যুক্তি হিসেবে গণিতের সূচনা ঘটেছে তারই হাতে। অদ্ভুত একধরনের মরমিবাদের সঙ্গে গণিতের সম্পৃক্তি ঘটেছে তারই মধ্যে। দার্শনিকদের ওপর গণিতের যে প্রভাব, তার আংশিক কারণ পিথাগোরাস। এই প্রভাব গভীরতর হয়েছে তার সময় থেকে পরবর্তীকালে এবং তা হয়েছে দর্শনের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।