গ্রিসে যে সাতজন মনীষীর প্রত্যেকে একটি করে প্রজ্ঞাময় উক্তি করার জন্য বিশেষভাবে খ্যাতিমান ছিলেন, থেলিস তাদের একজন। থেলিসের উক্তিটি একটি ভ্রান্তি, তিনি মনে করতেন পানিই সর্বোত্তম। অ্যারিস্টটলের মতে : থেলিস মনে করতেন পানি হচ্ছে আদিমৌলিক সারবস্তু, যা থেকে অবশিষ্ট সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করতেন, পৃথিবী পানির ওপর ভাসছে। অ্যারিস্টটল আরো বলেন, থেলিস বলেছিলেন, চুম্বকের মধ্যে একটি আত্মা থাকে, কারণ তা লোহাকে নড়ায়। তিনি আরো বলেছিলেন, সব বস্তুর মধ্যে দেবতারা আছে।
সবকিছুর উৎপত্তি পানি থেকে-এই বক্তব্যকে বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর এটি কোনোভাবেই নির্বোধ উক্তি নয়। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে গৃহীত মত ছিল যে সবকিছু হাইড্রোজেন থেকে সৃষ্ট, যে-হাইড্রোজেন কিনা আবার পানির দুই-তৃতীয়াংশ। গ্রিকরা নিজেদের অনুমানের ব্যাপারে ছিল হঠকারী, কিন্তু মিলেসীয় ধারাটি অন্তত নিজেদের অনুমানগুলো অভিজ্ঞতা দ্বারা পরীক্ষা করে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল। আমরা থেলিস সম্বন্ধে এত অল্প জানি যে, তার সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা সন্তোষজক দিকে পালটানোর সুযোগ তেমন নেই। কিন্তু মিলেটাসে তার উত্তরসূরিদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা গেছে, আর এটা মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে, তাদের বিশ্ববীক্ষার কিছু কিছু এসেছিল থেলিস থেকেই। থেলিসের বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ই কাঁচা, কিন্তু সেগুলো চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ উদ্দীপ্ত করার পক্ষে সহায়ক ছিল।
থেলিস সম্পর্কে অনেক কাহিনি-উপকথা চালু আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমার উল্লিখিত তথ্যাগুলোর চেয়ে বেশি আর কিছু তার সম্পর্কে জানা যায়নি। তার সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনিগুলোর কিছু কিছু শুনতে বেশ প্রীতিকর। যেমন-একটি বলেছেন অ্যারিস্টটল, তার পলিটিক্স গ্রন্থে : লোকেরা তাকে (থেলিসকে) তার দারিদ্র্যের জন্য গালমন্দ করত, যা থেকে মনে করা হতো যে, দার্শনিকরা কোনো কাজের নয়। কাহিনিটি অনুসারে, গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে দক্ষ ধারণা থেকে থেলিস এক শীতকালে টের পেলেন, পরবর্তী বছর জলপাইয়ের ফলন খুব ভালো হবে। তার যে সামান্য অর্থ ছিল তা দিয়ে তিনি কিওস ও মিলেটাসের সব জলপাইয়ের ঘানি ভাড়া করার জন্য অগ্রিম বায়না করে রাখলেন, তা তিনি করতে পারলেন খুব সস্তায়, কারণ সেসব নেওয়ার জন্য ওই মুহূর্তে তার কোনো প্রতিযোগী ছিল না। তারপর যখন ফসল তোলার মৌসুম এলো এবং প্রচুর লোক জলপাইয়ের ঘানির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল, তখন তিনি সেগুলো ছেড়ে দিলেন নিজের ইচ্ছেমতো দরে এবং এ থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেন। এভাবে তিনি জগৎকে দেখিয়ে দিলেন যে, দার্শনিকরা ইচ্ছে করলে অর্থ উপার্জন করে ধনী হতে পারে। কিন্তু তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো ভিন্ন প্রকৃতির।
মিলেসীয় ধারার দ্বিতীয় দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার। তিনি থেলিসের চেয়ে বেশি আগ্রহোদ্দীপক এক চরিত্র। তার সময়কাল অনিশ্চিত, তবে বলা হয়, তিনি ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কাছাকাছি সময়েই যে তা ঘটেছিল এ ধারণার পেছনে যুক্তি আছে। অ্যানাক্সিমেন্ডার মনে করতেন সব বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে একটিমাত্র আদিবস্তু থেকে, কিন্তু তা থেলিসের দাবিকৃত পানি বা আমাদের পরিচিত কোনো পদার্থই নয়। তা অসীম, শাশ্বত, সময়নিরপেক্ষ এবং তা সব বিশ্বকে বেষ্টন বা আবৃত করে রয়েছে-তিনি মনে করতেন আমাদের জগৎ অনেক জগতের একটি মাত্র। সেই আদিবস্তু আমাদের কাছে পরিচিত বিভিন্ন পদার্থে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সেগুলো। আবার একটি থেকে আরেকটাতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ সম্বন্ধে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও লক্ষণীয় মন্তব্য করেছেন :
যে-রূপ থেকে বস্তুগুলোর উদ্ভব ঘটে নিয়তিনির্ধারিতভাবে তারা আবার সেই রূপের মধ্য দিয়ে যায়, কারণ কালের বিন্যাস অনুসারে তারা তাদের পরস্পরের অন্যায্যতার ক্ষতিপূরণ ও সন্তোষ বিধান করে।
মহাজাগতিক এবং মানবিক-উভয় অর্থে ন্যায্যতার ধারণা গ্রিক ধর্ম ও দর্শনে এমন এক ভূমিকা পালন করেছে যা আধুনিক মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে বোঝা সহজ নয়। ন্যায্যতার নিহিতার্থ যা ছিল, আমাদের ব্যবহৃত ন্যায়বিচার বা ন্যায্য আচরণ তা প্রকাশ করে না বললেই চলে। কিন্তু এর চেয়ে জুতসই আর কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অ্যানাক্সিমেন্ডার যে চিন্তা প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা বোধ করি এই : বিশ্বে আগুন, পানি ও মাটির একটি নির্দিষ্ট অনুপাত আছে। কিন্তু এই তিনটি উপাদানের প্রত্যেকটি (মনে করা হচ্ছে যে তারা প্রত্যেকেই একজন করে দেবতা) অবিরামভাবে তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু একটি অনিবার্যতা বা প্রাকৃতিক নিয়ম রয়েছে যা অবিরামভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। যেমন-যেখানে আগুন আছে, সেখানে আছে ছাই। আর ছাই হলো মাটি। ন্যায্যতার অর্থ শাশ্বতভাবে নির্ধারিত সীমাগুলো অতিক্রম না করা। এই ধারণা ছিল গ্রিক বিশ্বাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গভীর ধারণাগুলোর একটি। দেবতারাও ঠিক মানুষের মতোই এই ন্যায্যতার অধীন ছিল। তবে খোদ চূড়ান্ত শক্তিটি নিজে ছিল নৈর্ব্যক্তিক, তা কোনো সর্বময় ঈশ্বর ছিল না।